প্রথম দেখা
--ইমরান খান রাজ
ঘড়ির সময় ঠিক বিকাল ৪টা বাজতেই অহনার মোবাইলে সেট করা এলার্ম বেজে ওঠলো। অল্প শব্দেই আজ তার দুপুরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অবশ্য তার একটা বিশেষ কারনও আছে বটে। বিগত একবছরের অপেক্ষা, ধৈর্য আর ভালোবাসা আজকে তার ফল দিবে। সে জানে যে, "অপেক্ষার ফল অতি মিষ্ট"। ঘুম ভাঙ্গতেই খুব তাড়াহুড়ো করে ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে গেলো। মোবাইলটা হাতে নিতেই সে দেখতে পায়, অপরপ্রান্ত থেকে তার মনের মানুষ তার জন্য একটা ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছে। বেশ আগ্রহ এবং মনের মধ্যে খানিকটা কৌতূহল নিয়েই মেসেজটার দিকে চোখ বুলায় অহনা।
মেসেজ দেখেই তার চোখ কপালে ওঠলো! আর কারো নয়, তার মনের মানুষ আরিয়ান তাকে মেসেজ পাঠিয়েছে। ঠিক ৪:৩০ মিনিটে রমনা পার্কে থাকতে হবে। কোনভাবে দেরি করলে আর কখনো দেখা হবেনা তাদের ! এমনি এক কঠোর বার্তা পাঠায় আরিয়ান। ছেলেটা কঠোর হলেও মনের দিক থেকে অনেক বেশিই নরম। যাই হোক, আরিয়ানের মেসেজ দেখে দ্রুত পার্কে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠে বসলো অহনা। চালক প্যাডেল দেওয়ার সাথে সাথে একটু মৃদু হাওয়া এসে লাগছিলো অহনার গায়ে। এরকম স্নিগ্ধ বাতাস ঢাকা শহরে সচরাচর অনুভব করা যায়না। রিক্সার চাকার সাথে ঘুরছে অহনার মাথায়ও নানান চিন্তাভাবনা। আরিয়ানকে নিয়েই ভাবছে। এইতো কিছুদিন আগের কথা, হঠাৎ ফেসবুকে পরিচয় হলো তাদের। শুরুতে আরিয়ানের মেসেজের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকতো সে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেও আরিয়ানের নরম হৃদয়ে প্রবেশ করতে শুরু করলো। সেই থেকেই শুরু। আজ দেখতে দেখতে একবছর পার হয়ে গেছে। সম্পর্কের এতটা সময় অতিবাহিত হবার পরেও তারা কেউ কাউকে দেখেনি। কিভাবেই বা দেখবে? দুজনেরই ফেসবুক প্রোফাইলে ছিলো পাখির ছবি। আর এই দিকটাতেই মিল থাকার কারনেই হয়তো সে আরিয়ানের প্রেমে পড়ে যায়। অহনার পাখি পোষার শখ ছিলো সেই ছোটবেলা থেকেই। তার এখনো মনে পরে সেই চড়ুই পাখিটার কথা। যখন তারা গ্রামে ছিলো তখন তাদের ঘড়ের টিনের চালার কোনোএক কোনে ছিলো চড়ুই পাখিটির বাসা। অহনা প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পূর্বে এবং স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বিকেলে ধান ছিটিয়ে দিতো। দুইবেলা খাবার দেওয়ার কারনে চড়ুই পাখি দুটি হয়তো অহনার বাধক হয়ে গিয়েছিল। পাখি দুটিও ঠিক সময়মত বাসা থেকে নিচে মাটিতে নেমে ছুটোছুটি করতো। পাখির সাথে তখনি তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে অহনা। তাই তার কোনো বায়না'ই বাবা-মা ফেলে দিতে পারতো না। তাই মেয়ের চড়ুই পাখির জন্য বাজার থেকে ধান কিনে আনতো বাবা।
অহনা যেতে যেতে প্রায় পার্কের কাছেই চলে
এসেছে। সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই তার। তখনো সে শুধু তার আরিয়ানকে নিয়েই ভাবছে। কেমন হবে আরিয়ান? আমাকে কি তার পছন্দ হবে? আমিতো দেখতো তেমন সুন্দর নই! নানান প্রশ্ন করছে সে নিজেকেই। একবছরের দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আজ অবশেষে দুটি ভালোবাসার মানুষের প্রথম দেখা হতে যাচ্ছে। কিভাবে শান্ত রাখবে মনকে? অহনা সেটাই বুঝতে পারছে না। তার অবুঝ মন বারবার শুধু প্রথম দেখার অপেক্ষা করছে।
কল্পনার জগৎ থেকে বের হতেই পার্কের গেটের কাছাকাছি এসে অহনা লক্ষ করে নীল শার্ট আর একগুচ্ছ লাল ফুল নিয়ে পিছু হয়ে কেউ একজন দারিয়ে আছে। তখনো রিক্সায় বসে আছে অহনা। মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা কেমন জোরে জোরে শব্দ করছে তার। মুখে কিছুটা হাসি নিয়ে ভাবছে আরিয়ানের কথা। এটাই তার আরিয়ান। লাল গোলাপ হাতে দারিয়ে আছে। দূর থেকে প্রথম দেখেই আন্দাজ করে ফেলে সে। অবশ্য তার ব্যাক্ষাটাও খুব সহজ। নীল রঙটা দু'জনের কাছেই খুব প্রিয়। তাই গতকাল রাতেই তারা নীল শার্ট আর নীল শাড়ী পড়ে প্রথম দিন দেখা করার প্লানিং করে ফেলে।
পার্কের গেটের অপরপ্রান্তে রিক্সা থামার শব্দ পেয়েই আরিয়ানের বুকের ভেতরটা কেমন যেনো কেপে ওঠলো। তার অহনা এসে গেছে। পিছন ফিরে তাকাতেই সে দেখলো নীল শাড়ী পড়া একটি মেয়ে রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালো। মুখে কিছুটা হাসি ছিলো দু'জনেরই। অহনা চোখে কাজল দিয়েছে আর তার কথামতো কপালে একটি লালটিপও আছে। আরিয়ান তা দেখেই যেনো অহনার চোখের মায়ায় পড়ে যায়। হাত উঁচু করে ইশারা করে অহনাকে। প্রথম দেখা হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সে। অহনাও হাত তুলে তার ভালোবাসার মানুষের ডাকে সাড়া দেয়। আরিয়ান দারিয়ে আছে রাস্তার ওপারে। একটা অবর্ণনীয় মুহুর্তের অপেক্ষায় দু'জন দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো তারা দু'জনে দু'জনার দিতে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে কি যেনো দেখছে তারা। হয়তো শতজনম পর তাদের দেখা হয়েছে, তাই শুধু পাথর হয়ে দারিয়ে আছে দুটি মানুষ। আরিয়ান হাত ইশারা করে অহনাকে, রাস্তার এপার আসার জন্য। সময় চলে যাচ্ছে! পার্কে বসে হাতে হাত রেখে তারা গল্প করবে। দু'জনের ছোটবেলার স্মৃতিগুলো শেয়ার করবে। আরো কত কি! আরিয়ানের ইশারা বুঝতে পেড়ে রাস্তা পাড় হচ্ছে অহনা। একপা-দু'পা করে এগুচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, এইতো সেই মুহুর্ত। যার জন্য দীর্ঘদিন মনে কষ্ট নিয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে। আজকের পর থেকে আর এমনটা হবেনা। এরপর যখন ইচ্ছা সে আরিয়ানকে দেখতে পাবে। আর তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষারত থাকতে হবেনা।
অহনা ধীরে ধীরে আরিয়ানের দিকে তাকাতে তাকাতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। রাস্তা পাড় হবার সময় সে কোনদিকে খেয়াল করছে না। বিন্দুমাত্র ভয় করছেনা তার। কারন, তার মাথায় এখন শুধু আরিয়ানের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তাকে স্বাগত জানাতে পার্কের গেট থেকে আরিয়ান হেটে হেটে রাস্তার কিনারার দিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ আচমকা একটা গাড়ী এসে অহনাকে তীব্র ধাক্কায় ফেলে দিলো রাস্তার এককোনে। একমিনিট এর জন্য আরিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কি দেখলো? অহনা এক্সিডেন্ট হয়েছে? নাকি সে ভুল দেখছে! তার অহনা কই? দৌড়ে সে অহনার কাছে ছুটে গেলো। একমুহূর্তের মধ্যেই চারিদিকে মানুষের ভিড় জমে গেলো। সবাই শুধু দেখছে আর যে যার মতো কথা বলছে। মানবসৃষ্ট ভীর ঠেলে আরিয়ান সামনে যেতেই দেখলো তার অহনা মাটিতে পড়ে আছে। যেকিনা তার সাথে দেখা করার জন্য গত একটি বছর অপেক্ষা করেছে। অহনার মাথা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আরিয়ান চিৎকার দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ে। অহনার মাথাটি তার কোলে রেখে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অহনার দিকে। চোখের কোন থেকে কখন যে ফোটায় ফোটায় জল গড়ানো শুরু হয়েছে আরিয়ান তা লক্ষ করেনি। অহনাকে বুকে টেনে নিয়ে ভাবছে, তোমার সাথে শুধু প্রথম দেখাটাই হলো। প্রথম কথাটা বলা হলো না।
--------------------------------------------------
ইমরান খান রাজ
কবি ও লেখক
নারিশা, দোহার-ঢাকা, বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment