Wednesday, 29 July 2020

গল্প : শুভ্রা চক্রবর্তী

লেখিকা পরিচিতি : শুভ্রা চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন ভারতবর্ষের আসাম রাজ্যের লামডিং শহরে ১৯৭৩ সালে।  পিতা স্বর্গীয় শ্রী দেবেশ চন্দ্র চক্রবর্তী (অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর) রেলওয়ে চাকুরে ছিলেন । মা স্বর্গীয়া শ্রীমতি সবিতা চক্রবর্তী হাউজ ওয়াইফ ছিলেন । বি.এ. পাঠরতা যখন,তখন এই পরম মেধাবী, মামাগৃহে পালিতা সবিতা চক্রবর্তীর বিবাহ হয় । শুভ্রাদের বাড়িতে সর্বদাই সুশিক্ষা, দেশী-বিদেশী সাহিত্যিক পুস্তক-ম্যাগাজিন-পত্রিকা পঠন, সাহিত্যিক আলোচনা, মানব-মানবেতরদের প্রতি প্রেম, সততা, উদারতার শিক্ষাপরিবেশ ছিল । শুভ্রা চক্রবর্তী তাঁর পিতার অবিবাহিতা কন্যা সন্তান হিসেবে ওঁর পেনসন পান । 


গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ।  হিন্দিতে শায়রী আর বাংলায় কবিতা লেখেন । গল্পকার,প্রবন্ধকারও বটে । মানব এবং মানবেতরদের স্বীয় সাধ্যানুযায়ী সহায়তা করেন । এ'বছরই (২০২০) আত্মজীবনী গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবেন। 

-------------------------------------------

দুই মন্-যাযাবরীর কাহিনী


মেয়েটির নাম সুলেখা। চৌদ্দ বছরের কিশোরী। ক্লাস নাইনের ফার্স্টগার্ল ।  বয়েসে যদিও আমার চাইতে অনেক ছোট, কিন্তু ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো । 💞

সুলেখা মেয়েটি একটু অদ্ভুত প্রকৃতির । বয়েসের তুলনায় সে অতিরিক্ত সরল । দুষ্টুমির ক্ষেত্রে সে আট বছরের শিশুর মতো । সুলেখা ভ্রমণবিলাসী । মাঝেমাঝেই ডুব দেয় । স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের সময়টা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় । এভাবে ঘুরতে গিয়ে  দু'বার সে বিপদেও পড়েছে । দু'-দু'বার সাপের ছোবল থেকে কোনোক্রমে বেঁচে ফিরেছে । তবু সে ঘুরবেই । কোনো ভয় কাকে বলে সুলেখা তা জানেই না । মাঝেমাঝে আমিও তার সঙ্গী হই । ওর সঙ্গে যখন মিশি, তখন আমাকেও কিছুটা শিশুসুলভ ব্যবহার করতে হয় । অবশ্য দুষ্টু মিষ্টি সরল সুলেখার পাল্লায় যে পড়েছে তাকেও বাচ্চামো করতে হয় । ওকে দেখলে আমার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে যায় । এম.এ. পড়াকালীন ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল । মেয়েটির টাইপ ছিল এই সুলেখারই মতো । তবে সেইসঙ্গে সে বুদ্ধিমতীও, বয়েসের তারতম্যে । ওর বন্ধন ভালো লাগতো না । তাই অনেক প্রপোজাল পাওয়া সত্ত্বেও অ্যাফেয়ারেও রাজী হতোনা । আমি, অঙ্কিতা আর রিমিতা একজন স্যারের কাছে প্রাইভেটে পড়তাম । অসম্ভব গম্ভীর প্রকৃতির রাশভারি স্যার ! ফাইনাল ইয়ারে পাপিয়া মানে সেই বান্ধবী পড়তে এলো । ঠিক দু'সপ্তাহের মধ্যে স্যারের বাড়িতে আমাদের অধ্যয়ন-পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে দাঁড়ালো । আমরা তো স্যারকে খুব ভয় পেতাম । কিন্তু পাপিয়া দেখলাম — ভয় তো নেই-ই । স্বভাবসিদ্ধ চঞ্চল সরল ভঙ্গিমায় সে হেসে হেসে সেই প্রথমদিন থেকেই স্যারের সঙ্গে কথা বলতো । এরপর আমাদের স্যার (!) — তিনি আমাদের সঙ্গে রোমান্টিক হিন্দি সিনেমার গল্প সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক গল্প বলতেন। 💞

সুলেখাকে এভাবে স্কুল পালিয়ে না বেড়াতে আমি বারণ করেছিলাম । কিন্তু সে শোনেনি । অবশ্য উপদেশ মনের মতো না হলে তার কারোও কথাই শ্রবণগোচর হয় না । আমি কথাটা বলতেই একটু হেসে সে বলেছিল,"জীবনটা কতদিনের বলতো দিদি ! আর আমি তো পড়াশুনো ঠিক রাখি । আসলে না স্কুলে যেতে আমার একদম ভালো লাগে না ।" আমি আর কিছু বলিনি । জানি, অবাধ্য অবুঝ মেয়েটিকে বলে কিছু লাভ নেই । 'জীবনটা কতদিনের...' শুনে আমার হাসি পেয়ে গিয়েছিল । কী  জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ দার্শনিকের মতো গভীর সুরে কথাটা বলেছিল সে ! 💞


একদিন আমি আর সুলেখা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে এসে দাঁড়ালাম । সুলেখা একটা পাথর হাতে নিয়ে নদীর একটা জায়গায় ছুঁড়ে দিয়ে বললে, "জানো সুমিতা দি,এখানে যে চোরাবালি ! আমি একদিন ডুবতে ডুবতে কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিলাম ।" ভয়বিস্মিতা আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, "কীভাবে বাঁচলি ?" কিছুটা লজ্জাজড়িত হয়ে মাথানীচু করে বলে সুলেখা, "ওই সুখেন্দু আমার সঙ্গে ছিল তো— । পা-দুটো গোড়ালি অবধি ডুবতে না ডুবতেই আমাকে টেনে তোলে ।" সুলেখার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করে একটু হেসে জিজ্ঞেস করি —
: হ্যাঁরে,তুই সুখেন্দুকে ভালবাসিস ?
: হ্যাঁ 
: আর সে ?
: সে-ও । ক্লাস সেভেন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব । 
: কোন্ ক্লাসে পড়ে সুখেন্দু ? 
: টুয়েল্ভথ্-এ 
: বিয়েটিয়ের কথা কিছু বলেছে ?
: বিয়ে ! (অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে সুলেখা) বিয়ে তো আমরা করবোনা দিদি...ওর সঙ্গে আমার এমনিই বন্ধুত্ব —
: কেন ? বিয়ে করবিনা কেন ? 
: আমার ভালো লাগে না । সুখেন্দু  অবশ্য বিয়ে করবে বলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল,কিন্তু আমি রাজী  হইনি । আমার প্রেমটেম করা, বিয়েটিয়ে এসব ভালো লাগে না । এমনিই বন্ধুত্ব করতে আমার খুব ভালো লাগে । আমি অনেক অনেক পড়বো দিদি...! অনেক পড়বো...! চাকরি করবো...দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াবো...!❤


সুলেখা তার যোগ্য কথাই বলেছে  । কাব্যিক কল্পনার সরল একঝাঁক মৌটুসী পাখিদের ন্যায় তার মনের আকাশ...মুক্তির ময়ূরপঙ্খী আঙ্গিনায় তার মন্-যাযাবরী বাস...যে যাযাবরিতা প্রকৃতির আঙ্গিক সীমাকে ভেদ করে যেতে পারে বৈদিকী অতীতে...! যেতে পারে ভবিষ্যতের সীমাকে লঙ্ঘন করে আরোও দূরভবিষ্যতে...! অসম্ভব নিঃস্বার্থ সরল এই সুলেখা ! আরেকদিকে মেধাবী স্টুডিয়াস্ লক্ষ্যবাদীও–।  কিন্তু, পারবে কী সুলেখা তার মনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণ দিতে — ! মনে পড়ে যায় পাপিয়ার কথা ! কোনোধরণের বন্ধন ভালো না লাগা পাপিয়া এখন পাটনায় চাকরি করছে । বর লেকচারার । ওদের ছ'বছরের মেয়েটি এখন স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে পড়ছে — 💞


ভাঙ্গাপথিক জীবনে অনেক টুকরো আশারা নীড় বাধে আমাদের মনের পত্রে পত্রে...কিছু ঘটে...অনেক পড়ে থাকে স্মৃতির সঞ্চিতাতে...আমাদের ব্যষ্টি জীবনের একান্ত মননে কতো আশাস্মৃতির চিরপুরাতন বাস...! বাস্তবের কঠোর পাথরে কেবল অঙ্কিত হয় আমাদের প্রাপ্য সত্যতা..💞


----------------------------------------------

No comments:

Post a Comment