লেখক পরিচিতিঃ লেখক শ্রী বাসব দেবনাথ মহাশয় জন্ম গ্রহন করেন ১৫ ই অক্টোবর, ১৯৭৪ সালে কোচবিহার জেলায়।
তিনি বর্তমানে ঘুঘুমারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করেন।
------------------------------------------------------------
গুজরাত ভ্রমণ
সময়টা ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস। নিউ কুচবিহার স্টেশন থেকে রওনা হয়ে যখন দ্বারকা স্টেশন এ নামলাম তখনও ভোর হতে একটু বাকি। পূর্ব আকাশ ধীরে ধীরে লাল রঙ এ রঙীণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ছোট্ট, পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন দ্বারকা স্টেশন দেখেই বেশ ভালো লেগে গেল। আমরা তিন দিনের দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা করে ভারতের প্রায় পশ্চিম প্রান্তে এসে পৌঁছেছি দেবভূমি ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এর বাসভূমি দ্বারকা ধাম এ । আচার্য গুরু শঙ্কারা আচার্য ভারতের চার প্রান্তে যে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই পরবর্তী কালে নাম হয় চার ধাম। ভারতের পূর্ব প্রান্তে পুরী ধাম, পশ্চিম প্রান্তে দ্বারকা ধাম ,উত্তর প্রান্তে বদ্রিনাথ ধাম,দক্ষিন প্রান্তে রামেশ্মরম ধাম। হিন্দুদের কাছে এই চার ধাম খুবই পবিত্র তীর্থ ভুমি মনে করা হয়। বিশ্বাস আছে এই চার ধাম দর্শন করলে মোক্ষ ( salvation) লাভ হয়।
সকালের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হোটেল এর উদ্দেশ্যে । কাছেই পেলাম বেশ সুন্দর ধরমশালা । বিশ্রাম সেরে আমরা সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম দ্বারকা ধাম অর্থাৎ দ্বারকা মন্দিরে প্রবেশের অপেক্ষায়। হাঁটা পথে মুহূর্তেই পৌঁছালাম মন্দিরের সদর ফটক এর সামনে। বিশালাকার মন্দির ,তার ওপর পাঁথরের আসাধারন কাজ। শিল্পীর নিপুণতা সকলকে যে মুগ্ধ করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গোমতী নদী আরব সাগরে মিলিত হয়েছে যেখানে তার প্রায় কোল ঘেঁসে গড়ে উঠেছে এই দ্বারকা শহর এবং এই সুসদৃশ মন্দির খানি। ঐতিহাসিক শহর দ্বারকা ই হোল ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এর শাসন ভুমি। কথিত আছে দ্বারকা শহর আরব সাগরে তলিয়ে যায় ছয় ছয় বার। বর্তমান দ্বারকা শহর সপ্তম বার নির্মিত শহর। দ্বারকা শহরের অনতি দূরেই রয়েছে “ভেট দ্বারকা” । ভেট দ্বারকা যাওয়ার জন্য রয়েছে জাহাজ ,ছোট ছোট ট্রলি। নির্দিষ্ট সময়ে ভিড়ময় এক জাহাজে কোনক্রমে আমরা চড়ে পড়লাম ভেট দ্বারকার উদ্দেশ্যে। আরব সাগরের জল কে ভেদ করে ২০-২৫ মিনিট যাওয়ার পর এলো সেই ভেট দ্বারকা । এটি একটি ক্ষুদ্র জনপদ। বিষ্ণু মন্দির ই এর প্রাণ কেন্দ্র। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে মন্দির প্রাঙ্গন হয়ে উঠেছে আরও বেশি প্রাণময়। কথিত আছে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ তার বন্ধুবর সুধাম কে দ্বারকার এই অংশ ভেট হিসাবে দান করেছিলেন তাই এর নাম “ভেট দ্বারকা”। দ্বারকায় এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। রুক্মিণী মন্দির এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য । সারাদিনের শেষে মন্দির প্রাঙ্গন সংলগ্ন বিশাল আহার গৃহে পেলাম সুমধুর প্রসাদ। সারাদিনের ক্লান্তি যেন এক লওমায় সব উবে গেল সাথে সাথে। শান্ত এবং উৎফুল্ল মনে গোমতী আর আরব সাগরের পাড় ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ধরমশালায় এসে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। দেবভুমির প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলো অবিস্মরণীয় । আগামীকালের গন্তব্য হল সোমনাথ......
……রাত্রের ট্রেন এ দ্বারকা থেকে আবারও ভোঁর হওয়ার আগেই পৌঁছে গেলাম সোমনাথ।মন্দিরের কাছেই পেলাম ধরমশালা। সকালের স্নান সেরে সবাই ছুটে গেলাম পৃথিবী বিখ্যাত শিল্প নৈপুণ্য ভরা গুজরাতের পশ্চিম কুলে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত সোমনাথ মন্দিরে। ১২ টি জ্যোতির লিঙ্গের মধ্যে প্রথম এই মন্দির। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অনুপ্রবেশকারী দের হাতে এই মন্দির ধ্বংস হয়েছে একবার দুবার নয় ,ধ্বংস হয়েছে ১৮ বার। বর্তমান মন্দির ১৯ তম তৈরি মন্দির। বর্তমান মন্দির টি স্থাপনা হয় ১৯৫১ সালে। ইতিহাস আর অবস্থানগত দিক দিয়ে সোমনাথ মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম । হাল্কা গেরুয়া বর্ণের ৫০ ফুট মন্দিরের চুড়োয় ১০ টনের সোনার জল করা কলস। মুল মন্দিরে ঢোকার মুখে ৫১ ফুটের দিগ্বিজয় দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই অপরুপ কারুকাজ চোখে পড়বে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি নেই। বাইরে থেকেই দেখা যাবে চন্দন চর্চিত স্বয়ম্ভূ মহাদেবের বিগ্রহ, যার মাথায় ছত্রাকারে ফণা তুলে ধরেছেন সর্পরাজ। যেমন সুন্দর তেমনি মূল্যবান। প্রতি প্রান্তেই যেন সোনা ছড়ান । মন্দিরের একপ্রান্ত এসে ঠেকেছে সাগরের কোলে। সাগরের ঢেউ বারবার এসে যেন কথা বলে । এই সাগর দেখেছে বহিঃ শত্রুর পৈশাচিক আক্রমণ, লুণ্ঠন, ধ্বংস লিলা। শুনতে পেয়েছে কত স্বজন হারা মানুষের চিৎকার ,কত মায়ের কোল হারাবার তীব্র আর্তনাদ। তবুও এই মন্দির দাড়িয়ে আছে স্ব মহিমায়। মুল মন্দিরের ব্যারিকেড এর কাছেই গোলাপি রঙা আদি সোমনাথ মন্দির। ইন্দরের রানি অহল্যাবাঈ ১৭৮৩ সালে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। এখানেও রয়েছে নানান গল্প কথা। রয়েছে শিবলিঙ্গ। রয়েছে অহলেশ্বর শিবের মূর্তি । কাছেই ত্রিবেণী সঙ্গম। হিরন,কপিলা ও অন্তঃ সলিলা সরস্বতী নদীর মিলন স্থল। দারুন মনোরম পরিবেশ। ঘুরতে ঘুরতে এলাম শঙ্কর আচার্য এর ধ্যান গুহা, কামনাথ মহাদেব মন্দির, সূর্য দেবতার মন্দির, পাণ্ডব গুহা,গীতা মন্দির, পরশু রাম মন্দির,বলরাম গুহা, শশিভূষণ মন্দির এর চত্বরে । চলে এলাম ভালুক তীর্থ এ। প্রবাদ আছে এখানেই জরা নামের এক ব্যাধ বিশ্রামরত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ কে হত্যা করে। জরা ব্যাধ আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর মূর্তি রয়েছে এখানে । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এর পাদুকাদ্বয় এর পূজা হয় এখানে। পিছনেই আরব সাগরের বিস্তার। মন্দিরের প্রসাদ নিয়েই দুপুরের আহার মিটে গেল। মন্দির, শ্রীকৃষ্ণ,ভারতের সনাতনী ইতিহাস এর পাতায় আমরা যেন বারবার হারিয়ে গেলাম। ফিরে এলাম আবার সোমনাথ মন্দির এর আঙিনায়। পুরাকাল থেকেই সোমনাথ হিন্দুদের পবিত্র তীর্থভূমি । হাজার হাজার মানুষের নিত্যদিনের ভিড় ,শাঁক ,শঙ্কের শব্দ, পুরোহিতদের সন্ধ্যা আরতি, সাথে হাজার হাজার ভক্তের ভক্তি ভাব …এ সোমনাথ অনন্য। সন্ধ্যায় এক প্রান্তে চলে “লাইট অ্যান্ড সাউন্ড” শো। ইতিহাস যেন রক্তে মাংসে মানুস হয়ে আমাদের বিবেকে আঘাত করছে বারবার। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আর প্রাণ চঞ্চল ভরা রুপকথার কাহিনি যেন এই সোমনাথ। ইতিহাসের পাতায় যেতে যেতে মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। সারদিনের ক্লান্তি আর ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলাম ধরমশালায়। রাতের খাবার নিলাম বটে কিন্তু মন পরে রইল সোমনাথ আর সোমনাথের ইতিহাসের পাতায়। আগামী কালের “গীর” আর “দিউ” যাওয়ার প্ল্যানে আমার কোন মনই বসলো না। ইতিহাস কে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না...
সাত সকালেই সোমনাথ এর ধরমশালা থেকে একটা গাড়ি বুক করলাম “গীর অরণ্য” এবং “ দিউ”ঘুরে আবার সোমনাথ এ ফিরে আসবার জন্য । চা এবং সামান্য কিছু স্নাক্স খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গুজরাতের গীর অরণ্য যাওয়ার অভিপ্রায় আমার দীর্ঘ দিনের। সিংহের দেখা পাওয়ার আসায় আমার ৪ বছরের শিশু কন্যা ও ১০ বছরের ভাগ্নের উৎসাহ সত্যি সবাইকে যেন আরও ব্যাকুল করে তুলল। ঘণ্টা ৩ যাওয়ার পর প্রবেশ করলাম বহু প্রতিক্ষিত গীর অরণ্য সাফারী সেন্টার এর সামনে। আমরা ৮ জন। একসাথে ২০-২৫ জনের টিম। আমরা উঠে পড়লাম সাফারি বাস এ। বাসের দরজা ও জানালা ভালো ভাবে আটকে দিল গাড়ির চালকের সহকর্মী । গাড়ি চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে গাড়ি পৌঁছে গেলো অরণ্যের অনেকটা ভিতরে । চলেছি ত চলেছি……….। ওই যে ওই যে ….সমস্বর চিৎকারে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি একটি গাছের নিচে বনের রাজা সিংহ তার শাবক দের নিয়ে বেশ সুন্দর ভাবে বসে আছে। গাড়ি থেকে দূরত্ব ৫০ মিটার হবে হয়তো। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। যে যেভাবে পারছে বনের রাজা কে ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যাস্ত হলাম। মিনিট কয়েক পর গাড়ি চলতে শুরু করে এক বাঁক নেওয়ার পরই হঠাৎ করে গাড়ি দাড়িয়ে পড়ল। কি হল কি হল ভাবতেই দেখি গাড়ির খুব কাছেই এক সিংহ । গাড়ি আর সিংহ এর মধ্যে অন্তরায় শুধু একটি ছোট গর্ত। এত কাছ থেকে বনের রাজাকে দেখার উন্মাদনায় সবাই বেশ হুড়োহুড়ি করতে লাগলাম। মোবাইল ,ক্যামেরার ফ্ল্যাশে সবাই যেন আত্মহারা । চালক ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলল। মুহূর্তেই বাস এর মধ্যে সবাই চুপ। চারিদিকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস। । বাচ্চারা যেন কিছুটা হতবাক…….। নিঃস্তবতা যেন আর কাটছেই না। ধীরে ধীরে সিংহ সরে গেলো। চালকের সহকর্মীর কথা থেকে বুঝলাম এত কাছে সিংহ সাধারণত আসে না। গাড়ি আবারও চলতে শুরু করল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই আবার যেন আনন্দ উচ্ছাসে এই এক অসাধারন অভিজ্ঞতাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলাম। অনেক আনাচে কানাচে ঘুরে আর কোনও সিংহ এর দেখা পেলাম না। অনেক হরিণ, ময়ূর দেখতে পেলাম। আরও অনেক জীবজন্তু। দেখতে পেলাম খাঁচায় বন্দী বাঘ আর শুনতে পেলাম অসম্ভব তাঁর গর্জন । বনে থেকেও বাঘ যে কেন খাঁচায় বন্দী বোধগম্য হোল না। গভীর বনের নিস্তবতা থেকে ধীরে ধীরে হালকা বনে আসতেই বুঝলাম আমাদের বন সাফারি শেষ হতে চলেছে। আরও আরও দেখার ইচ্ছে নিয়েও বাস থেকে নেমে পড়তে হল। সময় যে অনেকটা কেটে গেছে কারো কোন খেয়ালী নেই। “গীর অরণ্যে” এর এই অভিজ্ঞতা জীবন সম্ভারে যে এক নতুন মাত্রা যোগ করলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । বেলা ২ টা বাজে। খুদায় পেট যে চো চো করছে। আমরা আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কে নিয়ে খাওয়ার হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
খাওয়া শেষে ছুটে চললাম সমুদ্র সৈকত “দিউ” এর উদ্দ্যেশে। ড্রাইভার বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল । গাড়ির জানালা দিয়ে আসা সমুদ্রের হাওয়ায় সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। সূর্য এর প্রখর তেজ, আকাশ বাতাস এ যে রুক্ষতা ধীরে ধীরে যেন বদলে যেতে লাগলো। বুঝলাম আমরা আমাদের গন্তব্যে এসে গেছি। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম পাম,ঝাউ গাছের সারি। পড়ন্ত বেলায় সূর্যের সোনালি আলোয় সৈকত এর বালি যেন সোনার মতো চিকচিক করছে। পিচের রাস্তা সোজা চলে গেছে ওই দূরে । দুধারে রয়েছে অসংখ্য ঝাউ,পাম এর সুন্দর মেল বন্ধন । ঘেরাটোপে গাড়ি রেখে আমরা সবাই এগিয়ে চললাম বালিকাময় পথ ধরে সমুদ্রের ধারে। ছোট কিন্তু রুপ রঙে এই বীচ যেন বড় মায়াবী। দ্বারকা ,সোমনাথ এর পর দিউ এর সমুদ্র সৈকত যেন এক স্বপ্ন পুরী। বেশ ভিড় কিন্তু বড় কোন কোলাহল নেই। স্নান ,স্নলকেলিং,স্কেটিং সবই হচ্ছে আনন্দের সাথে ,সবই যেন সুন্দর এক নিয়মের বাঁধনে। আমাদেরও অর্ধ স্নান প্রায় হয়ে গেলো। মেয়ে আর ভাগ্নে তো জল থেকে আসতেই চায় না। পাড়ে বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ আর বাচ্চা দের জলের সাথে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘড়িতে যে ৭ টা বেজে গেছে খেয়াল হোল ড্রাইভারের ডাকে। এদিকে সন্ধ্যে হয় দেড়িতে। ধীরে ধীরে নিঃশব্দে সন্ধ্যে হোল কিন্তু কৃত্রিম আলোর রশনায় সহজে বোঝাই গেলো না। কিছু খাবার খেয়ে আলোর রশনা কে পিছনে ফেলে সবাই ছুটে চললাম সেই সোমনাথের ধরমশালার পথে। কাল সাত সকালে সোমনাথকে চির বিদায় জানিয়ে এই গাড়ি নিয়ে যাব পোরবন্দর । আজ ধরমশালা পৌছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। ব্যাগ পত্তুর কিছুই গোছানো হয়নি । কখন যে হবে, কিভাবেই বা হবে তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।
সোমনাথ থেকে পোর বন্দর পৌছতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। রাস্তায় নিজেদের কিছু সমস্যার কারনে আবার কিছুটা অকারনে এই দীর্ঘ পথে বারবার দাঁড়াতে দাঁড়াতে যাওয়ায় আমরা যখন পোরবন্দরের “হোটেল মুন” এ ঢুকলাম তখন বিকেল ৪ টা । পথের ক্লান্তিতো ছিলই, এছাড়া সবার শরীরও সমান সাথ দিচ্ছিলও না। রুমে একটু রেস্ট নিয়েই ছুটলাম আগামীকালের “ভুজ” এ যাওয়ার টিকিট কাটতে । পেয়েও গেলাম প্রত্যাশা মতোই। আগামীকাল বিকেল ৪ টায় ট্রেন। যাব ভুজ ,আমেদাবাদ হয়ে। আজকে আর কারো কোথাও যাওয়ার মতো ইচ্ছেও নেই, সময়ও নেই।
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম পোরবন্দর ঘুড়তে । গান্ধীজীর জন্ম ভিটা আমাদের প্রথম দর্শন স্থান। এখানেই বেশ সময় লেগে গেল। অনেক দর্শক । গান্ধিজির বিভিন্ন ঘর বেশ সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত আছে। মিউজিয়াম টাও খুব সুন্দর। স্বাধীনতা আন্দলনে গান্ধীজীর বিভিন্ন ছবি আজও যেন কথা বলে। দেশ বিদেশের দর্শকে এ যেন এক জীবন্ত লাইব্রেরি । এর পরে আমরা গেলাম কীর্তি মন্দির। এটি গান্ধীজীর প্রকৃত জন্ম স্থান। মন্দির সংলগ্ন পৈতৃক ভিটাতে ২ রা অক্টোবর ১৮৬৯ সালে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী জন্ম গ্রহন করেন। অনেক ইতিহাস কে সাক্ষী রেখে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী এবং তাঁর ধর্ম পত্নী কস্তূরবা গান্ধীর স্মৃতিতে তৈরি হয় এই কীর্তি মন্দির। এর পরে যাই সন্দীপনী বিদ্যানিকেতন এ। এ এক অপূর্ব গুরুকুল যা ইংলিশ এবং স্থানীয় গুজরাতি ভাষায় শিক্ষা দান করে থাকে। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভায় শোভিত প্রাঙ্গন , ছাত্রাবাসের সনাতনী পোশাকে পাঠরত শিক্ষার্থী, তাদের শৃঙ্খলা ,নিয়মাবর্তিতা আমাদের কে দারুন ভাবে হৃদয় স্পর্শ করল। অনতি দূরেই রয়েছে ভারত মন্দির। এর স্থাপত্য ও শিল্পকলাকে বুঝতে ও উপভোগ করতে বেশ সময় লাগে। বিপরীতে নেহেরু্ প্ল্যানেটরিয়াম । চলে এলাম পোর বন্দর বীচ এ। হাতে আজ আর বিশেষ সময় নেই। আরব সাগর এর পাড়ে বেয়ে ওঠা বন্দর সত্যিই বড় সুন্দর। এই সৌন্দর্য উপভোগ কে অপূর্ণ রেখে ছূটে এলাম হোটেল এ। ট্রেন এর সময় যে হয়ে এলো। হোটেলের ডাইনিং এ যা পাওয়া গেলো গোগ্রাসে তাই সবাই খেলাম। পেট ভোরে কারো খাওয়াই হোল না। সবাই প্রায় পাগলের মতো ছুটলাম পোর বন্দর রেল স্টেশনে। ট্রেন প্রায় ছেড়ে দেয় দেয় । তাড়াতাড়ি করে সবাইকে ট্রেন এ উঠিয়ে ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে হাফ ছেড়ে বসলাম। ট্রেন ও চলতে শুরু করল। আরেক টু দেরি হলে কি যে ক্যলেঙ্কারি হতো তা ভাবতেই পারছি না......
এমনিতেই গরম তাঁর ওপর এতো হুড়োহুড়ি করে ট্রেন এ উঠে একদমই সারা শরীর ঘামে ভিজে গেলো। শরীর ও মন শান্ত হলে বুঝলাম ট্রেন বেশ জোরেই ছুটছে। এখন যাচ্ছি আমেদাবাদ। রাতে ট্রেনে যা পাওয়া গেলো তাই খেয়ে নিলাম। আমেদাবাদ স্টেশনে ট্রেন বদল করে যখন ভুজে যাওয়ার ট্রেন এ উঠলাম তখন রাত্রি ১.৩০ ।
পরের দিন সকাল ৮ টায় এসে পৌছালাম ভূজ স্টেশনে। স্টেশন এর বাইরে আসতেই ভুজের নীল আকাশ, রোদ্রকরউজ্জ্বল সকালের হালকা মন মুগ্ধকর হাওয়া যেন আমাদের সবাইকে স্বাগত জানাল । ভারতের সবচেয়ে বড় জেলা হল কচ্ছের রণ। আর তাঁর সদর শহর হল “ভুজ”।.২০০১ সালের ভয়ানক ভূমিকম্পের ক্ষয় ক্ষতি সামলে এ শহর আজ বেশ আধুনিক আর সুন্দর। আর একে কেন্দ্র করে ঘুরে নেওয়া যাবে কচ্ছের বৈচিত্র্যের বিশাল সম্ভার।
“পঙ্কজ গেস্ট হাউস” থেকে আমরা বিশ্রাম সেরে বেড়িয়ে পড়লাম। শহরের সমস্ত রাস্তা এসে মিলেছে “জুবিলি গ্রাউন্ডে”। আমরা সবাই একটি স্করপিও নিয়ে রওনা দিলাম মান্ডবী বীচের দিকে। দূরত্ব ৬০ -৬৫ কিমি হবে। পড়ন্ত বিকেলে বীচে উট বা ঘোড়ায় চড়ার মজাই আলাদা। বেশ কিছুক্ষণ বীচে কাটিয়ে চললাম মাণ্ডবী প্যালেস বা বিজয় বিলাস প্রাসাদের দিকে। সৈকত থেকে প্রাসাদে যাওয়ার পথে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো পথের পাশে এক ছোট্ট জলাশয়ে। সুন্দর পাঁচিল ঘেরা জলাশয়ে যেন চাঁদের হাট বসেছে। গাইড জানালো জলের বুকে বসে আছে এক ঝাঁক ডাল মেশিয়ান পেলিকান নানান ভঙ্গিমায়। রঙ্গিন ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পেইন্টেড স্টর্ক। ফ্লেমিঙ্গ সেই অর্থে অনেক কম। স্পট বিলড ডাক,স্পুন বিল আর স্টিন্ট অসংখ্য। একসঙ্গে এতো পাখী এতো কাছের থেকে দেখে এবং এদের এতো সুন্দর সুন্দর নাম শুনে আমরা আনন্দে আত্মহারা। গাইড এর তাড়নায় এগোতে হল রাজবাড়ীর দিকে। দূর থেকে নজরে আসে প্রাসাদের উপরিভাগ। ভিতরে যেতেই নজরে এলো মাঠের মাঝে জমিদার বাড়ির মতো এই প্রাসাদ.। ১৯২০ সালে কচ্ছের জাদেজা বংশীয় রাজাদের গ্রীষ্ম কালীন আবাস হিসাবে এটি নির্মিত হয়। বর্তমানে রাজা আর রানিমা থাকেন উপরিতলায়। এখন লিফট সহ সব আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। প্রাসাদের কিছুটা অংশে চলছে হোটেল ব্যবসা। বলিউড এর বহু সিনেমার শুটিং হয় এখানে। আজ এখান থেকেই ফিরে যেতে হবে ভুজে। সন্ধ্যের পর পর ফিরে এলাম ভুজে। শহরের এক পাশে প্রাগমহল প্যালেস আর আয়না মহল। অন্যদিকে ভুজের স্বামী নারায়ণ মন্দির। মন্দিরে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। আগামীকাল এই ড্রাইভারকে নিয়েই যাব বৃহৎ রণের দিকে।
ভুজ দর্শন শেষ করে আজ আমরা পাড়ি জমালাম বৃহৎ রণ এর পথে। স্থানীয় শব্দ “রণ” কথার অর্থ বালুময় পতিত জমি। বিস্তীর্ণ এই লবণাক্ত নিচু জমি ঘিরে রয়েছে উপদ্বীপের মতো জায়গাটাকে। বর্ষার সময়ে জলে ভরে ওঠে রণ অঞ্চল। বর্ষা শেষে আবার দেখা যায় কাদামাটি মেশানো বেলাভুমি। উপদ্বীপের মাঝখানটা তুলনায় উঁচু, অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মত। তার থেকেই এর নাম “কচ্ছ”।
সকালের চা খাবার খেয়েই রওনা দিলাম খাবড়া হয়ে কালাদুঙ্গার এর পথে। পথের দূরত্ব ৯০-১০০ কিমি হবে। ভুজ থেকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি পথেরপাশে কাঁটা ঝোপের প্রাবল্য ততই বাড়ছে। রণ উৎসবের জন্য তোরণ বানানো চলছে। অল্প কিছুদিন পরেই রণ উৎসব। হড়কার পথ ফেলে আমরা আরও এগিয়ে চলছি খাবড়ার দিকে। কাঁটা ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে লবণাক্ত সাদা বেলাভূমি। খাবড়া থেকে কালা দুঙ্গার আরও ২৮-৩০ কিলোমিটার। দুপুরেই পৌঁছে গেলাম কালা দুঙ্গার। কালা দুঙ্গার বা কালো পাহাড় কচ্ছের রণের উচ্চতম অঞ্চল। গাড়ি থেকে নেমে হেটে বা উটের পিঠে চড়ে ওপরে ওঠা যায়। এখান থেকে পাখির দৃষ্টিতে বৃহৎ রণের অনেকটা অংশ দেখা যায়। সীমানার ওপারে পাকিস্থান। তাই এখানে রয়েছে সামরিক ছাউনি। টিলার মাথায় প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো মন্দির “দত্তাত্রেয়” । ব্রক্ষা, বিষ্ণু,মহেশ্বর এই ত্রয়ী এর মিলিত অবতার হল “দত্তাত্রেয়”। কথিত আছে “দত্তাত্রেয়”তার পৃথিবী পরিভ্রমণ কালে এই কালো পাহাড়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। এখানে এসে দেখেন একদল শিয়াল অনাহারে মৃত প্রায়। তখন তিনি তাঁর দেহ উৎসর্গ করেন এই অনাহারক্লিষ্ট শিয়ালদের। কিন্তু শিয়ালরা ভগবান “দত্তাত্রেয়” এর দেহাংশ ভক্ষণ করলেও পুনরায় তাঁর শরীর পূর্ণগঠিত হতে থাকে। সেই ঘটনাকে স্মরণ করেই এই মন্দির স্থাপন। আর প্রতি সন্ধ্যেয় পূজোর শেষে পুরোহিতেরা প্রসাদ আর ভাত সাজিয়ে দেন সেই সকল শিয়ালদের জন্য। এই প্রথা চলে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই টিলা ধাপে ধাপে নেমে গেছে সামনের বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে। টিলার ওপরেই রয়েছে সামরিক বাহিনীর দূরবীন। অনেক অনুরোধে তা ব্যবহারের অনুমতি মেলে তাদেরই তত্ত্বাবধানে। দূরবীন দিয়ে ওপর থেকে নজরে আসে সেই লবণ মাটির উপর দিয়ে চলে গেছে এক লম্বা ব্রিজ আরও ভিতরে। তবে সেটা কেবল সামরিক প্রয়োজনেই ব্যবহার হয়ে থাকে। নেমে এলাম টিলা থেকে। এবার ছুটলাম রণের অনেকটা ভিতরে যেখানে রণ উৎসব চলে। ড্রাইভার জানাল উৎসব এখনও মাস দু এক দেরি। উৎসবের কেন্দ্র স্থল ধোরদাতে এসে পৌঁছালাম। ফাঁকা জায়গায় দূর থেকেই নজরে এলো পরপর রিসোর্ট এর সারি। তাঁবুর আকারে সজ্জিত “গোরেওয়ালি” ঘর পরপর । এখান থেকে আরও ৫ কিমি দূরে মরুভূমির পারকিং স্পট। গাড়ি এ পর্যন্তই যাবে। পথ কিন্তু এগিয়ে গেছে আরও বেশ কিছুটা। দু পাশে জলাভুমিতে সাদা স্ফটিকাকার লবনের বিস্তার যেন দিগন্ত ছোঁয়া। কেউ পায়ে হেটে ,কেউ বা ঘোড়া বা উটের টানা গাড়িতে চলেছেন সাদা ধু ধু মরুভূমির আরও গভীরে। আমরাও উঠে পড়লাম একটি উটের টানা গাড়িতে । সামনেই বিভিন্ন উচ্চতায় অনেক গুলো প্ল্যাটফর্ম । সেখানে অনেকেই উপভোগ করছেন পাখির দৃষ্টিতে বৃহৎ রণের লবণের সমুদ্র, শ্বেতশুভ্র মরুভূমি আদি দিগন্ত বিস্তৃত। বরফ সদৃশ সেই লবণের মহাসাগরে প্রাণের বড় অভাব। পায়ের নীচে মুচমুচে লবন যেন বরফ, কোথাও পায়ের পাতা ডোবা ,কোথাও বা কঠিন ক্রিস্টাল এর মতো শক্ত। রাস্তা ছেঁড়ে আমরা আরও এগিয়ে গেলাম বরফের মতো পড়ে থাকা নুনের ওপর। নুনের এই বিস্তার কেমন যেন নেশা জাগানো। এ এক অন্যরকম অনুভুতি, কল্পনাতীত। যতদূর চোখ যায় চারিদিকেই সেই বরফের মতো লবণের সমুদ্র । আমরাও সেই লবণ সাগরে হারিয়ে গেলাম যে যার মতো। বৃহৎ রণের এই বিস্তীর্ণ সাদা ধু ধু মরুভূমির বুকে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ি অনেকটা ভিতরে , একাকী। বাধাহীন দৃষ্টি সীমানায় শুধুই সাদা সাদা লবণ মহাসাগরের বিস্তার হারিয়ে গেছে দিগন্তের ওপারে। চেনা জগতের বাইরে, বইয়ের পাতায় পড়া বা দেখার থেকেও অচেনা অদেখা, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ঘড়িতে নজর পরতেই চেতনা ফিরে এলো। বেলা প্রায় ২ টা বাজে। এখান থেকে আমরা যাব নারায়ণ সরোবরে। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ১৮০ কিমি। রাস্তার ধারের হোটেল থেকে খাবার খেয়ে গাড়ি ছুটল হু হু করে। কিন্তু মনটা পড়ে রইল সেই লবণ মরুভূমির শ্বেত শুভ্র প্রাঙ্গণে।
কচ্ছের কর্কশ রুক্ষ লবণাক্ত অনাবাদী জমি ছুঁয়ে এ চলা অন্যরকম। সাদা নুন বিছিয়ে থাকা বরফের মতো প্রান্তরে চড়া রোদের ছটা চোখে বেশ জ্বালা ধরায়। এখানে সেখানে ডিবির মতো উঁচু উঁচু করে রাখা নুনের স্তূপ। রাস্তায় কোন ভিড় নেই। রাস্তাও বেশ মসৃণ। গাড়ি ছুটে চলছে দুরন্ত গতিতে। হাল্কা নিদ্রা ভাঙতেই দূর থেকে নজরে এলো কোরি ক্রিক বা খাঁড়ি। খাঁড়ির ঢুকে আসা জলের মাঝ দিয়ে রাস্তা সোজা পৌঁছে গেছে নারায়ণ সরোবরে । এখানে সন্ধ্যে নামে বেশ দেরীতে। ঘড়িতে ৬ টার বেশি বাজে। সূর্য পশ্চিম প্রান্তে হেলে গেছে অনেকটাই। পড়ন্ত সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে বেশ। ভারতের পশ্চিমতম প্রান্তে কোরি ক্রিক বা খাঁড়ি লাগোয়া নারায়ণ সরোবর এক পবিত্র হিন্দু তীর্থ । সরোবর এর এক পাশে আদি নারায়ণ আর বিষ্ণু মন্দির। জলে নানান পরিযায়ী পাখী। অল্প দূরে খাঁড়ির মুখের দিকে অতি প্রাচীন কোটেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে দেখলাম দোকানীর অধিকাংশই বাঙালী। ভারী আনন্দ হল মনে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর লেখনীতে পাওয়া যায় কোটেশ্বর মহাদেবের এই প্রাচীন জনপদের নাম। মন্দির চত্বর থেকেই নজরে আসে এর প্রায় তিনদিক নুন মিশ্রিত জলে ঘেরা, দূরে এক লাইট হাউস। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মন্দিরের ছাঁদ থেকে সাগরের মতো খাঁড়ির বিস্তারকে দেখতে অপূর্ব লাগে। চারধারের পরিবেশ অসাধারণ। জলের মাঝে মন্দিরের অবস্থান সত্যি অনবদ্য। অস্তমিত সূর্যের লালাভ আলোয় এ যেন এক সাগর পাড়ের রূপকথা। এবার আমাদের ফিরে চলা ভুজে। হোটেলে খাবার খেয়ে গাড়ি ছুটল হু হু করে। গেস্ট হাউসে যখন ঢুকলাম তখন রাত্রি ১১ টা। আজ অনেক পথ ঘুরেছি । সবাই আজ খুব ক্লান্ত । শোওয়ার সাথে সাথে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। বৃহৎ রণের অনেকটাই আজ দেখে নিয়েছি । তবুও আরও কতো কি যে দেখা রয়ে গেলো বাকি।
গতকালের বৃহৎ রণের অখণ্ড অনাবিল আনন্দ আর সৌন্দর্য উপভোগ করে সবাই আজও বেশ ক্লান্ত। ক্ষুদ্র রণের “এস স্যাঞ্চুরি” ভ্রমণের আজকের প্ল্যানের কারো কোন ইচ্ছাই দেখতে পেলাম না।পথের ক্লান্তি যখন মনের অন্তঃস্থলে বেশি প্রভাব ফেলে তখন ভ্রমণের আস্বাদন সদর্থক হয়ে ওঠে না। তাই আমিও কাউকে আর বাইরে বের হবার জন্য জোরাজুরি করলাম না। ছুটির মেজাজে হোটেলের ঘরে শুয়ে বসে,হাসি ঠাট্টায় আর আলস্যতায় দিনটি কাটাতে বেশ ভালই লাগলো।
পরদিন খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ভুজের বাজার ,জুবিলী গ্রাউন্ড ,শহরের আনাচে কানাচে মর্নিং ওয়াকেই একা একাই একটু ঘুরে নিলাম। সমস্ত ক্লান্তি ঝেরে ফেলে খাওয়া দাওয়া সেরে “পঙ্কজ গেস্ট হাউস” কে বিদায় জানিয়ে চললাম ক্ষুদ্র রণের দিকে। বৃহৎ রণের বিশাল সম্ভারের কাছে একে দেখে মন খুব একটা ভরল না। দু একটা গাধা আর কিছু ফ্লেমিঙ্গ দেখেই খান্ত হলাম। আমাদেরও উৎসাহ এর কিছুটা খামতি ছিল। একরকম ক্ষুদ্র রণকে বুড়ি ছোঁওয়া করেই সন্ধ্যে সন্ধ্যে চলে এলাম ভূজ স্টেশনে । গন্তব্য আমেদাবাদ। টিকিট কাটাই ছিল। রাতের খাবার খেয়েই ট্রেন এ উঠে পড়লাম। ট্রেনে অতিরিক্ত কোন ভিড় নেই। ট্রেন ছুটে চলল আমেদাবাদের পথে। পৌঁছাব কাল ভোরে।
হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙে দেখি ট্রেন আমেদাবাদ স্টেশনে ঢুকছে। ভোরের আলো এখনও ফোটেনি। সকাল হলে আমরা ৮ জন শহরের জনবহুল এলাকায় “গুজরাত হোটেল” এ ঠাই নিলাম। গুজরাত ভ্রমনে এটাই আমাদের সর্বশেষ ঠিকানা। সকালের খাবার খেয়ে যথারীতি একটা গাড়ি ভাঁড়া করে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথম লক্ষ্যই হল “সবরমতি আশ্রম” বা “গান্ধী আশ্রম” । যাওয়ার পথেই শহরের উপকণ্ঠে এক জৈন মন্দির দেখে দাড়িয়ে পড়লাম। শ্বেতপাথরের তৈরি মন্দির আর তার প্রাঙ্গণে বসে থাকতে এতো ভালো লাগলো যা এক লহমায় শরীর মনকে শান্ত করে দিলো। শহরের ওপরে মন্দির অথচ নির্জনতা ,গাম্ভীর্যতায় সে যেন অনন্য। অবাক হওয়া তখনও বাকি ছিল যখন সারিবদ্ধ ভাবে প্রসাদ গ্রহণ করতে গিয়ে দেখলাম প্রসাদের সাথে সবাইকে একটা করে সাদা এনভেলপ প্রদান করা হচ্ছে। এনভেলপ খুলতেই পেলাম পরিষ্কার ২০ টাকার নোট। বাচ্চা ,বুড়ো, যুবক, যুবতী, ধনী, দীন সবাইকে এই রাশি প্রদানের হেতুটা কি কিছুতেই বোধগম্য হল না। কিছুটা আনন্দ কিছুটা অবাক হয়েই চললাম আমাদের গন্তব্যে।
পৃথিবী বন্দিত সবরমতি নদীর তীরে গান্ধী আশ্রমে মুহূর্তেই এসে পৌছালাম। এ যেন এক তীর্থক্ষেত্র। দেশ বিদেশের নামি দামী লোকের সমাবেশ এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। স্বাধীনতা আন্দলনের ভারতবর্ষে গান্ধীজী ভারত পরিভ্রমন বা কারাগার থাকা ছাড়া দু জায়গায় বেশি সময় কাটাতেন। একটি হল আমেদাবাদ এর এই সবরমতি আশ্রম, আরেকটি হল মহারাষ্ট্রের ওয়াড়ধায় সেবাগ্রাম। গুজরাতের এই সেই আশ্রম যেখান থেকে গান্ধীজী ডান্ডি অভিযান শুরু করেন ১২ ই মার্চ ১৯৩০ সালে যা লবণ সত্যাগ্রহ নামে বিশেষ ভাবে খ্যাত। এই অভিযান স্বাধীনতা আন্দোলনে দারুন প্রভাব ফেলে। তারই স্মরণে স্বাধিনত্তর ভারত বর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার এই “সবরমতি আশ্রম”কে জাতীয় স্বারক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। আশ্রম প্রাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে “নন্দিনি” (গেস্ট হাউস),”ভিনবা কুটীর” ,”উপাসনা মন্দির”, “মগন নিবাস”ইত্যাদি অনেক আশ্রম কুটীর । রয়েছে অতি উত্তম একটি মিউজিয়াম । মিউজিয়ামে রয়েছে “মাই লাইফ ইজ মাই ম্যাসেজ”নামে একটি গ্যালারি। এতে রয়েছে গান্ধীজীর অসংখ্য দুর্লভ ছবি। পুরো আশ্রম ঘুরতে অনেক সময় লাগে। এই আশ্রম শুধু ইতিহাস নয় এ যেন নিজেই এক সভ্যতা । এলাম সবরমতি নদীর পারে। নদীর ঘাঁট তার সাবেকীয়ানা ছেড়ে আজ অনেক আধুনিক। গাছের ছাওয়ায় নির্মল হাওয়ায় যে যেভাবে পারলাম বসে পড়লাম এখানে। বিশ্রামের সময়ের বাঁধন কে মানতেই চাইছে এ মন। তথাপি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই। এর পর এলাম আমেদাবাদের কাছে গান্ধীনগর জেলায় আডালাজ গ্রামে। এখানে রয়েছে “আডালাজ স্টেপ অয়্যল” বা “রুদাবাই সিঁড়ি কুয়া”। এই সিঁড়ি কুয়া নির্মাণ ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অদ্ভুত নিদর্শন। ঘুরতে ঘুরতে এলাম বৈষ্ণা দেবী মন্দির। একটা বড়ো পাঁথর কে কেটে কেটে বিভিন্ন পথ বেয়ে অনেক চড়াই উতরাই কে সঙ্গে করে পৌঁছাতে হবে দেবীর মুল কক্ষে । এ যেন জম্মুর কাটরার বৈষ্ণাদেবী দর্শনের স্মৃতি কে উসকে দেয়। এই অভিযান এক রোমাঞ্চকরও বটে। “টেক্সটাইল মিউজিয়াম”,”জামা মসজিদ” ঘুরে চলে এলাম “অক্ষরধাম মন্দিরে”। “অক্ষর ধাম” শব্দের অর্থ হল ভগবানের স্বর্গীয় আবাস স্থল । এখানে মানুষ ত্যাগ আর অনন্ত শান্তির প্রার্থনা করে থাকে । আমেদাবাদের এই মন্দিরটি স্থাপিত হয় ১৯৯২ সালের ৩০ শে অক্টোবর। মন্দিরে হিন্দুদের কাছে ভগবান “স্বামী নারায়ণ” পূজিত হন। প্রতিদিনই প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় । মন্দিরের অসাধারণ কারুকার্য , অতি সুন্দর ফুলের বাগান , ভক্তি, নিষ্ঠা আর নিয়মাবর্তিতা সবার মনকে দারুণ ভাবে আকর্ষণ করে। বিকেল হয়ে এলো। মন্দিরের বাইরে এসে গুজরাটি কিছু খাবার খেয়ে গাড়িতে চললাম। গাড়ি এসে দাঁড়ালো “কানকেরিয়া লেক” এর পাশে। আমেদাবাদ এর সবচেয়ে বড় লেক এটি। বহু পুরনো এই লেককে ঘিরে এক বিশাল সাম্রাজ্যের যেন বিস্তার ঘটেছে। কি নেই এতে। কানকেরিয়া চিড়িয়া খানা(নেহেরু জুলজিকাল গার্ডেন), বালভাটিকা(চিলড্রেন পার্ক) ,বেলুন সাফারি, অ্যামিউসমেন্ট পার্ক, টয় ট্রেন, নাগিনা বদ্বীপ, স্টোন পার্ক আরও কতো যে কি আছে ঘুরে শেষ করতে পারা গেলো না। অটল এক্সপ্রেস এ ( টয় ট্রেন) ৪.৫ কিমি লেকের চারধার ঘুরতে বেশ রোমাঞ্চকর লাগলো। ২০০৮ সালের ২৫ এ ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিবসে এই খেলনা ট্রেন টিকে লন্ডন থেকে এনে এখানে বসানো হয়েছে। এক সাথে আনন্দের এতো বাহার, উপভোগের এতো বৈচিত্র্য আর কোথাও পেয়েছি বলে ত মনে পড়ে না। এই লেকের কাছে এসে যুবক বুড়ো সবাই যেন শৈশবের স্মৃতিতেই থেকে যেতে চায়। শুনতে পেলাম প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে লেকের ধারে “কানকেরিয়া উৎসবে” দেশ বিদেশের আবাল বৃদ্ধবণিতা সবাই মেতে ওঠে আনন্দে। অনেক অনেক আনন্দকে সঙ্গে করে ফিরে এলাম হোটেল এ। আসবার পথে খুঁজে খুঁজে ভাত সব্জির হোটেল পেলাম বটে কিন্তু বাঙালী রান্নার স্বাদের অভাবে খাওয়াতে উদর আর ভরল না।
আজকের আমেদাবাদ ভ্রমণ দারুণ উপভোগ্য ছিল । গুজরাট ভ্রমণের আজই শেষ দিন। এবার বাড়ি ফিরবার পালা। গুজরাতে প্রকৃতির এতো সৌন্দর্য, এতো বৈচিত্র্য, স্থাপত্তের এতো নিপুণতা দেখলেও যেন দেখা শেষ হয়না। ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে বারবার। রাত্রেই ব্যাগ পত্তুর সবাই গুছিয়ে নিলাম। কাল সকালে প্রস্তুত হয়ে বেড়িয়ে যাবো স্টেশনে। আমেদাবাদ থেকে দিল্লী । তারপর দিল্লী হয়ে বাড়ি । একদিকে বাড়ি ফেরার আনন্দ অপরদিকে এই দীর্ঘ ১৭ দিনের গুজরাট ভ্রমনের ইতি টানতে কোথায় যেন একটা বিষাদের ছোঁওয়া লাগলো মনে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে মনের ভাবনায় মন্দির,সমুদ্র, বন্দর, লেক,মরুভূমি সব যেন একসাথে ভিড় করে এলো। সব কেমন যেন এলোমেলো হতে লাগলো। রেল লাইন ধরে কোথায় যেন ছুটে চলেছি আমি। অচেনা অদেখা এই পৃথিবীতে আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম।
------------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment