Tuesday, 28 December 2021

হামিদুল ইসলামের জীবনপঞ্জী


                          
আমি হামিদুল ইসলাম। আমার ছদ্মনাম লালন চাঁদ। জন্ম 1955 সালের 5 মার্চ। গ্রাম ভোঁওর পোষ্ট কুমারগঞ্জ জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর। বেশ কয়েক বছর হলো জন্মস্থান ছেড়ে কুমারগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। আমার বাবা  ঁমীরহোসেন মণ্ডল। মা  ঁহালিমা মণ্ডল। 
          শৈশব থেকেই আমি দেখে এসেছি আমাদের সংসারে অভাব অনটন। আমরা পাঁচ ভাই বোনের মধ‍্যে আমি দ্বিতীয়। দিদি সবার বড়ো। বাবা তৎকালীন ভোঁওর ইউনিয়ন বোর্ডের ট‍্যাক্স কালেক্টর ছিলেন। কিন্তু সারা মাসে কমিশনের যে টাকা আসতো তাতে সংসার চলতো না। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এমতাবস্থায় বাবা ইউনিয়ন বোর্ডের ওই কাজটি ছেড়ে দেন। পৈত্রিক জমি ছিলো বিঘে তিনেক। সেটার উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ওই জমিতে তখন ছিলো না কোনো সেচ। বছরে একটিই ফসল হতো। আমন ধান। সংসারে যেটুকু ধান আসতো সারা বছরের ঋণ মহাজনী শোধ দিতে দিতে অবশিষ্ট তেমন কিছুই থাকতো না। সারা বছরই কষ্ট। ধার দেনা বাকি অভাব অনটন। বিচ্ছিরি জীবন। এলেবেলে জীবন। 
           তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলো না। হেড স‍্যারের কটু ভাষায় অনেক গালি গালাজ শুনে সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়িতে আসলাম। 
            পড়াশোনার ব‍্যাপারে মা'র প্রচণ্ড আগ্রহ ছিলো। হাজার কষ্ট হলেও আমাকে পড়তে হবে। তাই আমাকে মামার বাড়িতে পাঠাবার বন্দোবস্ত হলো। আমি চলে আসলাম মামাদের বাড়ি। মামাদের অবস্থা স্বচ্ছল। সেখানেই কাটলো আমার শৈশব। এখান থেকেই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। পাশ করলাম থার্ড ডিভিশনে। 
            মামাদের বাড়িতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ‍্যার বৃদ্ধি। আমি ফিরে আসলাম বাড়ি। মনের মধ‍্যে জেদ চেপে বসলো। আমাকে পড়াশোনা করতেই হবে। বাবাকে বললাম সব কথা। বাবা টাকা ধার করে এনে দিলেন। আমি ভর্তি হলাম বালুরঘাট কলেজে। 
             প্রতিদিন ভোরবেলা বিছানা থেকে উঠতাম। গ্রামের ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াতাম। তারপর কলেজে রওনা দিতাম। কতোদিন যে আমি খেয়ে না খেয়ে কলেজে গেছি তা এখন ভাবলে শিউরে উঠি। 
             যখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র তখন স্কুলের ম‍্যাগাজিনে আমার প্রথম কবিতা " ভালোবাসা " প্রকাশিত হয়। কলেজ লাইফেও বেশকিছু পত্রিকার সাথে পরিচয় ঘটে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশ পায়। 
             কলেজের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হলো। কলেজে গেলাম। লিষ্টে দেখছি আমার নাম সবার উপরে। আমিই কলেজের ফার্স্ট বয়। মনটা নাচছিলো। যেনো হাতে স্বর্গ পেলাম। 
            আর পড়াশোনায় এগুতে পারলাম না। অনেক টাকার দরকার। কে দেবে টাকা ? ছেদ পড়লো পড়াশোনায়। 
             আমার বাবা কাকারা বাম আদর্শে বিশ্বাসী। আমিও ভীঁড়ে গেলাম সে নৌকোয়। পরিচিতি বাড়লো। এক জেঠু আমার এই অবস্থা দেখে একটি চিঠি দিয়ে আমাকে বললেন, এই চিঠিটা এলেন্দরী জুঃ হাই স্কুলের সেক্রেটারিকে দেবে। ওখানে একটা অরগেনাইজড স্কুল চলছে। ওই স্কুলে তোমাকে নেবার কথা বলেছি। আমি চিঠি নিয়ে গেলাম সেক্রেটারির কাছে। উনাকে আমার সব কথা বললাম। উনার মেয়ে আমাকে চা খাওয়ালো। 
             উনি আমাকে ওই স্কুলে অরগেনাইজড শিক্ষক হিসেবে নিলেন। বছর খানেক স্কুল করলাম বিনে পয়সায়। ইতোমধ‍্যে সেক্রেটারির মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়লাম। বিষয়টি জানাজানি হতেই আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করলেন সেক্রেটারি। 
ফিরে আসলাম বাড়ি। আমাদের চিঠির আদান প্রদান চললো তখনো। একদিন উনার মেয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসলো আমার বাড়ি। থানা পুলিশ হলো। থানায় ধরে আনলো আমাদের। আমরা আমাদের মতামত জানালাম। ও সি আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সেক্রেটারি সাহেব চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফিরে গেলেন। পরে অবশ‍্য স্থানীয় বিধায়ক (আমার কাকু ও কাকিমা ) ও উনার স্ত্রীর কথামতো বিষয়টি মিউচুয়াল হলো। 
            জীবনের সংগ্রাম থেমে থাকলো না একটি দিনের জন‍্যেও। পরের বাড়িতে গতর দিতে শুরু করলাম। পঞ্চায়েতের চৌকো মাটি কাটলাম। রাতে এম.এ.পরীক্ষার প্রস্তুতি চললো। কঠোর পরিশ্রম করলাম চার বছর। বাংলা ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলাম । 
             বছর দুয়েক বাদে শিক্ষক হিসেবে আমার চাকরি হলো। 
              লেখালেখির ছেদ পড়ে নি এ সব দিনগুলিতেও। অবসর গ্রহনের পর এখন অবশ‍্য চুটিয়ে লিখছি। এখন লেখাই আমার নেশা। সারাদিন কিছু না কিছু লিখি। গত বছর ' প্রাঙ্গণ সাহিত‍্য পত্রিকা ' থেকে " সাহিত‍্যরত্ন " ও " কবি সাগর " সম্মাননা পেয়েছি। এ ছাড়া এসেছে বহু শংসাপত্র। মেমেন্টো। এ বছর রাজ‍্য ওয়ারি দুটো সাহিত‍্য পত্রিকায় আমার কবিতা প্রথম হয়েছে। এ যাবৎ ন'টি একক কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। চল্লিশটির মতো যৌথ কাব‍্য সংকলন গ্রন্থ। তিনটি ই কাব‍্যগ্রন্থ। একটি অপ্রকাশিত কাব‍্যগ্রন্থ। এখনো অপ্রকাশিত তেরো টি নাটক। সাতটি উপন‍্যাস। লেখা চলছে। পরিচিতি বেড়েছে বহুলাংশে। সাহিত‍্যিক হিসেবে এটাই আমার পাওনা। আমার গিন্নি বন্ধু হিসেবে থেকেছে আমার পাশে। মানুষের সহানুভূতি পেয়েছি অনেক। সহানুভূতির দরজায় এখন ভাসছে সাহিত‍্যের ভেলা। 


_____________________________________________________