Saturday, 18 July 2020

করোনা আবহে শিক্ষাব্যবস্থা --শিবাণী মণ্ডল।



   শিক্ষা ব্যতীত জাতির ক্রমমুক্তি নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অগণিত শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষা পিপাসু জনসাধারণ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। শিক্ষা এবং শিক্ষণ ব্যবস্থা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের যোগমিলনের ক্ষেত্রে অনন্ত বিশ্বের বিপুল জ্ঞানরাজি, ভাব ও চিন্তার আদান-প্রদানে পরিশীলিত ভাবীকালের রূপরেখা তৈরী করে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই। ছাত্র অর্থাৎ আগামী প্রজন্মের ভাবাবেগ ও চিন্তন শক্তিকে সুচারুভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই শিক্ষা, যা অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তির সঠিক পথ নির্দেশ করে। অতীতের গুরুকূল শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আর নেই, এখন শিক্ষার আদান-প্রদান পর্ব স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির মধ্যে ন্যস্ত। প্রাথমিক থেকে ক্রমশঃ উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যতের সোপান গড়া হয়ে থাকে স্কুল-কলেজেই। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও আদর্শ, নীতিগত ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের পরিকাঠামো নির্মিত হয় শিক্ষা প্রাঙ্গণে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমেই। 
   কিন্তু বর্তমানের অতিমারী কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে। অবরুদ্ধ জনজাতি সম্ভাব্য ধ্বংসের আশঙ্কায় প্রহর গুনছে। প্রতিষেধক অনাবিষ্কৃত থাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধে একমাত্র উপায় স্বাস্থ্য সচেতন ভাবে পরিচ্ছন্ন থেকে দূরত্ব বিধি মেনে চলা। এই পরিস্থিতি বর্তমানে সমগ্র মানবজাতিকে নির্বাসিত করেছে এক অন্ধকূপে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বর্তমান শিক্ষাবর্ষের প্রায় শুরু থেকেই, এর ফলে যেমন শিক্ষা দান ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে প্রগতির পথ। শিক্ষা প্রাঙ্গণগুলি বন্ধ থাকায় শুধুই যে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যেকার আদান-প্রদান বন্ধ হয়েছে, তা নয়, চরমভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে সামগ্রিক বিকাশের পরিসরটুকুও। 
   চির-দারিদ্র্য-নিপীড়িত ভারতবর্ষের অর্থনৈতিকভাবে নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এক শিক্ষাগ্রহণের সম্ভাবনাময় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল স্কুলে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন বা ‘মিড-ডে মিল’-এর ব্যবস্থা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাপনার সুফল-কুফলের বিতর্ক পরিহার করে যদি দেখা যায়, সেই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হওয়ার সেই সম্ভাবনাও বিনষ্ট হয়েছে। যদিও সরকারের তরফে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খাদ্য-সামগ্রীর প্রয়োজনীয় রসদ জোগানোর প্রচেষ্টা চলছে। 
   এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনেক সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট নির্ভর ‘অনলাইন’ পঠন-পাঠনের ব্যবস্থায় উদ্যোগী হয়েছে, যদিও যথেষ্ট পরিকাঠামোর অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্র-ছাত্রীরা এই শিক্ষাগ্রহণে অপারগ। কারণ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে প্রযুক্তিবিদ্যা ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহজলভ্য নয়। তাছাড়া শহরাঞ্চল ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যন্ত এলাকায় উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম না থাকার দরুন, নিয়মিত অনলাইন পঠন-পাঠনে অংশগ্রহণ ও সবার পক্ষে সম্ভবপর হয় না। এছাড়াও এই অনলাইন শিক্ষণ ব্যবস্থায় পুঁথিগত বিদ্যা বা থিওরী পড়ানো সম্ভব হ’লেও কারিগরিবিদ্যা বা প্রাকটিক্যাল কোনোভাবেই সম্পাদন সম্ভব নয়। সর্বোপরি, হঠাৎ করে পরিস্থিতির চাপে শুরু হওয়া এই নতুন ব্যবস্থাপনায় ছাত্র এবং শিক্ষক - উভয়েরই নিজেদেরকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হচ্ছে। শিক্ষকদের যোগ্যতা বা ছাত্রদের আগ্রহ - দুইয়ের কোনোটারই অভাব না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পরিকাঠামোহীন ব্যবস্থাপনার সাথে মানিয়ে না নিতে পারার জন্য ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু আদান-প্রদান। 
   এই স্তব্ধ পরিস্থিতিতে ব্যাহত হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থাও। শুধুমাত্র সংক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হয়েছে বহু পরীক্ষা। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও। মূল্যায়ন ক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণে সুযোগ ও সংস্থান থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়েছে বহু পরীক্ষার্থীকেই। 
   ভয়াবহ করোনা কবলিত আবহে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হ’ল, অগ্রসরের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। যদিও শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে বিজ্ঞান এই মারণ ভাইরাসের প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে সচেষ্ট, তবুও বর্তমানের থমকে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে বর্তমানসহ আগামী প্রজন্ম যে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এই দমবন্ধ-করা পরিস্থিতির কবে আর কোথায় শেষ, তার উত্তর সময়ই দেবে, এবং সেই শেষের পর আবার নতুন করে শুরুর আশা বুকে নিয়ে দিন গুনছে সবাই।।

Cppyrights@ S Mandal
-------------------------------------------------

শিবানী মন্ডল 
কবি-লেখিকা 
ঝাড়খন্ড, ভারতবর্ষ 

---------------------------------------------------------------

       Voice Literary Blog 
       Editor - Bijoy Sarkar 

Sub-Editor - Monowar Hossain 

       ..... Chief Organizer.....
           Chandan Mahanta  

Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice---------------

Sunday, 12 July 2020

নাগরিকতা জ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য --শিবাণী মণ্ডল


   মানুষের সমাজ ও সভ্যতা বহু সাধনার ধন। আদিম বর্বর আরণ্যক জীবন এবং আধুনিক উন্নত জীবনধারা - এই দুই দিগন্তের বিপুল ব্যবধানের মধ্যে লুক্কায়িত ক্রমোন্নয়নের বিস্ময়কর ইতিহাস, যার মর্মবাণী ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’। 
   নবলব্ধ উন্নত চেতনায় নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যেদিন যুক্ত হয়েছিল অপরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ভাবনা, সেদিন জাগ্রত হয়েছিল সামাজিক বোধ, সূচিত হয়েছিল নাগরিকতা জ্ঞান। ‘নাগরিক’ বা ‘নাগরিকতা’ শব্দবন্ধের সাথে ‘নগর’ শব্দের সাদৃশ্য থাকলেও ‘নাগরিকতা জ্ঞান’-এর অর্থ বহুব্যঞ্জক। প্রাচীন পৃথিবীতে যে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ‘নাগরিকতা জ্ঞান’ শব্দটির উদ্ভব সেই কুণ্ঠিত পটক্ষেপে। ব্যক্তিগত, ব্যষ্টিগত এবং সমষ্টিগত অধিকারগুলির সংরক্ষণের জন্য নৈতিক দায়বদ্ধতায় সার্বজনীন কল্যাণের মন্ত্রে সুশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগই হ’ল ‘নাগরিকতা জ্ঞান’। কিন্তু উন্নত সামাজিক চেতনা বা সোস্যাল কনশাসনেস ও প্রকৃত নাগরিকতা বোধ বা সিভিক সেন্স সমার্থকই, অর্থাৎ উন্নত নাগরিকতা জ্ঞান সমুন্নত সামাজিক চেতনারই রকম-ফের এবং তা কেবল নগরকেন্দ্রিক নয়, গ্রাম-গঞ্জ-শহর নির্বিশেষে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। 
   সমাজবদ্ধ সকল মানুষের কল্যাণে উন্নত নাগরিকতা জ্ঞানের প্রকৃত অভিজ্ঞান যার সাথে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ভারতবর্ষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিরকাল অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। এ ব্যাপারে ব্রিটিশদের কাছে প্রত্যাশা থাকলেও তাদের ভারত-বিদ্বেষী ও বঞ্চনা-প্রবণ মনোভাবের দরুন আশাভঙ্গ ঘটেছিল। ভারতবর্ষের বর্তমান জনস্বাস্থ্য-বিভাগ ব্রিটিশ শাসনেরই উত্তরাধিকার। বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হ’লেও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার চিত্র পূর্ববৎ মসীলিপ্ত। এই কেন্দ্রগুলি জনমানসে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে উন্নত নাগরিকতার জ্ঞানের বিকাশে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। 
   স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার বিকাশ মূলতঃ দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল - দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিক্ষার বিস্তার। ভারতবর্ষের প্রায় একশো তিরিশ কোটি জনসংখ্যার সিংহভাগই বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী। অসম্পূর্ণ শিক্ষার ও অজ্ঞতার অন্ধকারে অধিকাংশ ভারতবাসীই নির্বাসিত। সঙ্গত কারণে হীনমন্যতা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা বিশাল অসচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে, উন্নত নাগরিকতা জ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা আশা করা দুরাশা মাত্র, যার ফলে দেশের সমগ্র পরিবেশই অস্বাস্থ্যকর, আবর্জনা ও রোগব্যধির জীবাণু পরিপূর্ণ। জনভার জর্জরিত শহরগুলি তার স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা ও ব্যধিহীনতার কৃত্রিম পরিবেশ বজায় রাখতে ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে গ্রাম-গঞ্জের শ্রমিকশ্রেণী জীবন-জীবিকার স্বার্থে নির্মিত শহরের পরিবেশকেও জ্ঞানের অভাব ও স্বাস্থ্য-অসচেতনতার শিকার করে তুলছে প্রতিনিয়ত। 
   বর্তমানে অতিমারী কোভিড-১৯ এর প্রকোপ সেই অসচেতনতাকেই দর্শায়। উত্তরোত্তর সংক্রমণ বৃদ্ধি, আক্রান্তের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের বেপরোয়া জীবনযাপনের অতিমাত্রার নিদর্শন প্রকারান্তরে শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করে। সেই সাথে সরকারের তরফে যথোপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব সমগ্র দেশবাসীকে এক ভয়াবহ খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। একমাত্র সচেতনতাই এর প্রতিকার। 
   এই নৈরাশ্যজনক রূপ চিত্রণের পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সেই সাথে প্রয়োজন শিক্ষার সুসংগঠিত পরিকাঠামো। শিক্ষা প্রসারে নাগরিকতা জ্ঞান যেমন বিকশিত হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্য সচেতনতাও বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল হ’লে, সার্বিক বিকাশের পূর্ণায়ন সম্ভব হবে। এই দুইয়ের মধ্যস্থতায় সারা দেশে ফুটে উঠবে এক স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর আগামী। কিন্তু বর্তমানের নিরিখে এই আশার যৌক্তিকতা কতটা, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।।

Copyrights@ S Mandal 
----------------------------------------------- 
শিবানী মন্ডল 
কবি-লেখিকা 
ঝাড়খন্ড, ভারতবর্ষ 

---------------------------------------------------------------

       Voice Literary Blog 
       Editor - Bijoy Sarkar 

Sub-Editor - Monowar Hossain 

       ..... Chief Organizer.....
           Chandan Mahanta  

Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice---------------