মানুষের সমাজ ও সভ্যতা বহু সাধনার ধন। আদিম বর্বর আরণ্যক জীবন এবং আধুনিক উন্নত জীবনধারা - এই দুই দিগন্তের বিপুল ব্যবধানের মধ্যে লুক্কায়িত ক্রমোন্নয়নের বিস্ময়কর ইতিহাস, যার মর্মবাণী ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’।
নবলব্ধ উন্নত চেতনায় নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যেদিন যুক্ত হয়েছিল অপরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ভাবনা, সেদিন জাগ্রত হয়েছিল সামাজিক বোধ, সূচিত হয়েছিল নাগরিকতা জ্ঞান। ‘নাগরিক’ বা ‘নাগরিকতা’ শব্দবন্ধের সাথে ‘নগর’ শব্দের সাদৃশ্য থাকলেও ‘নাগরিকতা জ্ঞান’-এর অর্থ বহুব্যঞ্জক। প্রাচীন পৃথিবীতে যে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ‘নাগরিকতা জ্ঞান’ শব্দটির উদ্ভব সেই কুণ্ঠিত পটক্ষেপে। ব্যক্তিগত, ব্যষ্টিগত এবং সমষ্টিগত অধিকারগুলির সংরক্ষণের জন্য নৈতিক দায়বদ্ধতায় সার্বজনীন কল্যাণের মন্ত্রে সুশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগই হ’ল ‘নাগরিকতা জ্ঞান’। কিন্তু উন্নত সামাজিক চেতনা বা সোস্যাল কনশাসনেস ও প্রকৃত নাগরিকতা বোধ বা সিভিক সেন্স সমার্থকই, অর্থাৎ উন্নত নাগরিকতা জ্ঞান সমুন্নত সামাজিক চেতনারই রকম-ফের এবং তা কেবল নগরকেন্দ্রিক নয়, গ্রাম-গঞ্জ-শহর নির্বিশেষে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
সমাজবদ্ধ সকল মানুষের কল্যাণে উন্নত নাগরিকতা জ্ঞানের প্রকৃত অভিজ্ঞান যার সাথে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ভারতবর্ষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিরকাল অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। এ ব্যাপারে ব্রিটিশদের কাছে প্রত্যাশা থাকলেও তাদের ভারত-বিদ্বেষী ও বঞ্চনা-প্রবণ মনোভাবের দরুন আশাভঙ্গ ঘটেছিল। ভারতবর্ষের বর্তমান জনস্বাস্থ্য-বিভাগ ব্রিটিশ শাসনেরই উত্তরাধিকার। বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হ’লেও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার চিত্র পূর্ববৎ মসীলিপ্ত। এই কেন্দ্রগুলি জনমানসে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে উন্নত নাগরিকতার জ্ঞানের বিকাশে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার বিকাশ মূলতঃ দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল - দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিক্ষার বিস্তার। ভারতবর্ষের প্রায় একশো তিরিশ কোটি জনসংখ্যার সিংহভাগই বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী। অসম্পূর্ণ শিক্ষার ও অজ্ঞতার অন্ধকারে অধিকাংশ ভারতবাসীই নির্বাসিত। সঙ্গত কারণে হীনমন্যতা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা বিশাল অসচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে, উন্নত নাগরিকতা জ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা আশা করা দুরাশা মাত্র, যার ফলে দেশের সমগ্র পরিবেশই অস্বাস্থ্যকর, আবর্জনা ও রোগব্যধির জীবাণু পরিপূর্ণ। জনভার জর্জরিত শহরগুলি তার স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা ও ব্যধিহীনতার কৃত্রিম পরিবেশ বজায় রাখতে ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে গ্রাম-গঞ্জের শ্রমিকশ্রেণী জীবন-জীবিকার স্বার্থে নির্মিত শহরের পরিবেশকেও জ্ঞানের অভাব ও স্বাস্থ্য-অসচেতনতার শিকার করে তুলছে প্রতিনিয়ত।
বর্তমানে অতিমারী কোভিড-১৯ এর প্রকোপ সেই অসচেতনতাকেই দর্শায়। উত্তরোত্তর সংক্রমণ বৃদ্ধি, আক্রান্তের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের বেপরোয়া জীবনযাপনের অতিমাত্রার নিদর্শন প্রকারান্তরে শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করে। সেই সাথে সরকারের তরফে যথোপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব সমগ্র দেশবাসীকে এক ভয়াবহ খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। একমাত্র সচেতনতাই এর প্রতিকার।
এই নৈরাশ্যজনক রূপ চিত্রণের পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সেই সাথে প্রয়োজন শিক্ষার সুসংগঠিত পরিকাঠামো। শিক্ষা প্রসারে নাগরিকতা জ্ঞান যেমন বিকশিত হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্য সচেতনতাও বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল হ’লে, সার্বিক বিকাশের পূর্ণায়ন সম্ভব হবে। এই দুইয়ের মধ্যস্থতায় সারা দেশে ফুটে উঠবে এক স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর আগামী। কিন্তু বর্তমানের নিরিখে এই আশার যৌক্তিকতা কতটা, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।।
Copyrights@ S Mandal
-----------------------------------------------
শিবানী মন্ডল
কবি-লেখিকা
ঝাড়খন্ড, ভারতবর্ষ
---------------------------------------------------------------
Voice Literary Blog
Editor - Bijoy Sarkar
Sub-Editor - Monowar Hossain
..... Chief Organizer.....
Chandan Mahanta
Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice---------------
No comments:
Post a Comment