সারাদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে,একঘেয়ে ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না,বন্ধু নীলেশের মুখেই শোনা গল্প আজ আপনাদের শোনাবো- বর্ষাস্নাত এই রকমই দুর্গাপুজোর সময় একটা ঘটনা যা আজও নীলেশের কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।নদীয়ার বিখ্যাত মৃৎশিল্পী জীবন কৃষ্ণ পালের নাম শোনেননি এমন লোক খুব কমই আছে।নীলেশের পাশের গ্রামে কুড়ি-পঁচিশ ঘর বসতি নিয়ে কুমোড়পাড়া,সেখানকার মানুষেরা চাষাবাদ ছাড়াও বাড়তি রোজগারের জন্য অনেকেই বিভিন্ন মূর্তি,খেলনা ইত্যাদী তৈরী করতো।যাদের মধ্যে অন্যতম জীবন কৃষ্ণ পাল তার হাতে গড়া দুর্গা ঠাকুর সূদূর অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হয়েছে। সরকার থেকে বিশেষ পুরস্কৃতও হয়েছেন।অথচ মানুষটি কে দেখলে বোঝার উপায় নেই, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা,হাঁটুর উপর ধূতি একটা ফতুয়া,কখনো বা খালি গায়ে কাঁধে গামছা।বেশিরভাগ সময় খালি পায়ে হেঁটে চলে বেড়াতে ভালোবাসে।
জীবন বাবু মূর্তি গড়াই বেশি পছন্দ করে,এক একটা মূর্তি তৈরী করতে কয়েক মাস লেগে যেত, এই সময় নাওয়া খাওয়া ভুলে বিভোর হয়ে কাদামাটি দিয়ে আঙুলের টানে মূর্তি গুলো সব জীবন্ত হয়ে উঠতো.........
একমাত্র মা মরা মেয়ে দুর্গা ছাড়া তার ত্রিভূবনে কেউ নেই, দুর্গার জন্মের সময়ই তার স্ত্রী কমলবালা ইহলোক ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকেই জীবন বাবুই দুর্গার মা আবার বাবা।পরম স্নেহ যত্নে মেয়েকে লালন পালন করছেন এমনকি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দ্বিতীয় বার বিয়ে পর্যন্ত করেনি পাছে মেয়ের অযত্ন হয়।আড়ালে আবডালে লোকেরা কানাঘুষো করে,এই মেয়েটা অলক্ষী জন্মাবার সাথে সাথেই মা টাকে খেয়েছে। জীবন বাবু এসব শুনেও চুপচাপ থাকতো কারণ চলা পথ,বলা মুখ কখনো আটকানো যায় না।ক্রমশঃ দুর্গা বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠে সমত্থ মেয়েকে বেশি দিন তো নিজের কাছে রাখা যায় না তাছাড়া চোখ বুজলে মেয়েটার ভবিষ্যত কি হবে।সম্বল বলতে কাঠা চারেক জমি, কয়েকটা মেডেল আর শংসাপত্র।সাতপাঁচ ভেবে শান্তিপুরে একটি সম্বন্ধ ঠিক হলো।অগাধ জায়গা জমি,ব্যবসা বর্ধিষ্ণু বনেদী পরিবার। শান্তিপুরের বিখ্যাত রাশ মেলায় সুভাষ ঘোষের রাশের ডালা নামকরা,তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র অমর ঘোষের সাথে বিয়ে স্থির হয়েছে।
দুর্গা নামেও যেমন রূপে গুণেও তেমন সাক্ষাৎ মা দুর্গা- টানাটানা চোখ টিকালো নাক মাথা ভর্তি চুল লেখাপড়াও মোটামুটি জানে।নম্র ধীর স্থির এবং খুব সহজেই সকলকে আপন করে নিতে পারে এটাই হলো ওর মহৎ গুন।এসব দেখেই ছেলের বাড়ির লোক এককথায় বিয়ের দিন পাকা করে গেছে।তারা নিজেরাই মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
দুর্গা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি নয়,কান্নাকাটি করতে লাগলো।বাবা এই বয়সে তোমাকে কে দেখবে?আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না।
-- দুর পাগলি তুই তো আমার মা।তোর শক্তি,প্রেরণায় আমি ঠিক থাকবো,তুই চিন্তা করিসনা।বেশিরভাগ সময় জীবন বাবু দুর্গার কাছাকাছি থাকে,ছলছল চোখে দূর থেকে মেয়েকে সর্বদা নিরীক্ষণ করে।ছোট থেকে মানুষ করার সব ছবি মানসপটে ভেসে উঠে আসে।
যথারীতি ২রা আশ্বিন গোধূলি লগ্নে চারহাত এককরে কন্যা সম্প্রদানে শুভ বিবাহ প্রতিপন্ন হলো।পরের দিন মেয়ে জামাই কে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে বিদায় দিলেন। সমস্ত অনুষ্ঠান পর্ব জীবন বাবু দক্ষতার সাথে নিখুঁত ভাবে শেষ করলো।
এবারে পাঁচটা দুর্গা ঠাকুরের বায়না নিয়েছে।মোটামুটি সব শেষ হয়ে এসেছে শুধু একটা ঠাকুরের চোখ মুখ আঁকা বাকি।হাতে বেশি সময় নেই,মেয়ের শোক কে বুকে চেপে রেখে টিনের দরজা সরিয়ে ঠাকুরগুলো ফিনিশ করতে লাগলো,চোখ মুখ আঁকা প্রায় শেষ হঠাৎ বলকে বলকে নাক মুখ দিয়ে কাঁচা রক্ত উঠতে লাগলো,আপন মনেই বলে মা রে আর একটু সময় দে তোর মুখটা একটু পালিশ বাকি আছে।দ্রুত হাত চালাতে থাকে, বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না হাত থেকে তুলি ক্যানভাস পড়ে যায়........
বৌভাতের অনুষ্ঠান-মাথায় মুকুট,টানা নথ চন্দনের কল্কায় একেবারে প্রতিমার সাজে সিংহাসনে দুর্গা বসে আছে।অভ্যাগতদের সাথে আলাপচারিতার মাঝে মাঝে আকুল হয়ে চোখ দিয়ে কাউকে খুঁজছে।জামাই কে সাথে নিয়ে বাবা কাছে আসতেই দুর্গা বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। জীবন বাবু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বল্লো-কাঁদিস না মা কাঁদিস না, দেখবি এবারে আমি তোর ছেলে হয়ে তোর কাছেই থাকবো। এমন সময় দমকা হাওয়ায় লাইট নিভে গেল বাইরে বজ্র বিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে।পরের দিন সকালে খবর এলো জীবন বাবু মারা গেছে।
শোকে মূহ্যমান দুর্গাকে নিয়ে জামাই নদীয়ায় এসে পৌঁছালো। টিনের দরজা সরিয়ে সবাই দেখে মেঝেতে চাপ চাপ রক্তের মাঝে জীবন বাবুর নিথর দেহ পড়ে আছে তার ঠিক সামনের মূর্তি টা হুবহু মেয়ে দুর্গার মতো দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। পাড়ার লোকেরা বলে তুই যাবার পর এই ঘর থেকে আর জীবন বাবু বের হয়নি........??