Tuesday, 26 October 2021

মেস বাড়ির রকমারি রঙ্গ - শক্তি পদ সেন


  ভদ্রলোকের নাম বিপুল দাম। না, তিনি কোন নামী ব্যক্তিত্ব নন। মানে তিনি কোন কিছুর উদ্বোধন করেননি বা কোন গদ্য বা পদ্য লেখেননি। তা যা হোক, ওই ভদ্রলোকের সাথে আমার একবার আলাপ হয়। ওটাকে খেজুরে আলাপ ই ধরে নিতে পারেন। আচ্ছা দেখুন, আজকালকার দিনে শাক - সবজি, জামাকাপড়, খাদ্য - দ্রব্য, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকস সব কিছুরই দাম বাড়ছে আর একদিকে মানুষের দাম কমছে। তো দেখুন,নামটাই হলো তাঁর বিপুল দাম। সত্যিই তাঁর দাম কিন্তু বিপুল ই, অন্ততঃ তাঁর বন্ধু - বান্ধব,শুভানুধ্যায়ী, অনুসারী সকলের কাছেই। ভদ্রলোকের কথায় এমন যাদু যে কথায় কথায় আপনাকে কিছুক্ষনের মধ্যে বিমোহিত করে ছাড়বেন। তিনি আমার কাছে একদিন গল্প করেছিলেন।তিনি নাকি বরাবরই হোস্টেলে বা মেসে থাকতেন। সত্যি, এমন জমাটিয়া মানুষ দুনিয়াতে খুব কমই দেখা যায়।তিনি বেশ রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন সাথে কিছুটা রস ঢেলে। সেদিন সকলেই আমরা তক্ত পোশের উপর বসে আছি। হঠাৎ ই তাঁর বিপুল - বিশাল শরীরটা দেখিয়ে তিনি গলা ছেড়ে গান ধরলেন ---" আমার এই বিপুল বিশাল দেহখানি তুলে ধরো,,,,,। আর মেসের সকলে তাঁর গানের সাথে সাথে তাল ধরে নাচতে শুরু করল। দু - চার জন তো থালা বাজাতে শুরু করল। ওই গানের পর ই আরেকজন আরেকটা গানের তালে তালে নাচতে শুরু করল ---- " জানা, ও মেরি জানা,,, অ্যয় ম্যায় তেরে রাজা,,,লায়লা,, ও মেরি লায়লা,,,। আ। - যা,,মেরে বাহু মে আ,, যা,,,,।সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল সকলের উদোম নাচ। মেস বাড়ির আশেপাশের উঠতি বয়সের ছেলে - মেয়েরা জানলা থেকে উঁকি মেরে দেখে আনন্দ উপভোগ করতে লাগল।
  পরে অবশ্য শুনেছি -- কেউ কেউ নাকি এতে বিরক্ত হয়ে মেস বাড়ির কাজকর্মের ব্যাপারে তিরস্কার ও করেছে। তবে কে কার কথা শুনে ? দিনের পর দিন মেসের এই হযবরল দিনের পর দিন চলতেই থাকত।
  কি অদ্ভুত জমিয়ে রাখার ক্ষমতা! দেখুন ,আমি বলেছি কিন্তু খেজুরে আলাপ। তার মানে এই নয় যে তিনি খাজুরা হের সব জিনিস পছন্দ করেন বা তার সাথে তাল মিলান। আসলে তাঁর রসের নৌকার খেয়া দিনে অন্ততঃ বিশ - পঁচিশ বার খেপ মারে।
   আর একবার তিনি শোনালেন --- মেসে দিন দুয়েক ঠাকুর নেই।আবার কাজের মাসিও বেপাত্তা। তো তখন সেই কাহিনী তিনি যা বললেন -- বেশ মজার ব্যাপার। তখনকার দিনে কয়লার উনুনে রান্না হত।সেই কয়লার ছাই পাশেই পড়ে থাকত।সকালে উঠে সবাই কার ডিউটি হল কয়লার ছাই দিয়ে থালা মাজা। তো তিনি নিজেকে এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ বলেই বর্ণনা করলেন। পাশাপাশি বসে লাইন দিয়ে সবাই থালা মাঁজছে।লাইন দিয়ে বলতে তখনকার দিনে মেয়ে বউরা যেমন লাইন দিয়ে পাথরের যাতায় মাসকলাই ভাঙত -- অনেকটা সেইরকম। তো বসে থালা মাজতে মাজতে অনেকের গুন গুন করে গান ও চলছে। কয়েকজন আবার উত্তেজনা চাপতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে কয়লার ছাই সহ থালা হাতে নাচতে শুরু করে দিল ---
"জানা, ও মেরি জানা,,,
এয়, ,, ম্যায় তেরে রাজা,,,
লায়লা, ও মেরি লায়লা,
আ,,,যা,,মেরে বাহু মে আ,,,যা,,,
  তো সময়টা গ্রীষ্ম কাল। কুয়োতেও বেশ একটা জল নেই। কোন রকমে বালতি নামিয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে আধ বালতি করে জল বার কয়েক উঠল।নাচা গানার পালা শেষ হলে কোন রকমে সবাই থালাগুলো তখন পরিস্কার করে নিজের নিজের জায়গায় রাখল।
  তারপর আরেক জনের গান সমেত নাচ শুরু হল। মেস বাড়িতে শুরু হল --" জিলে লে,,, জিলে লে,,,আও ,,, আও আও জিলে লে,,,,। মানে ওই আলুভাতে গিলে লে,,,,গিলে লে,,,,। সত্যিই সেদিন আলুভাতেই হল। ঠাকুর তো নেই। কারুর রান্নার অভিজ্ঞতা নেই। কোন রকমে মশাই সেই বড়ো হাঁড়িতে কয়লার উনুনে বানানো আলু ভাতই খাওয়া হল। তার অধিক আর কিছুই জুটল না। এদিকে অনেক দেরি করে চান টান করে খাওয়া হল।ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল।
  এবার এল চায়ের পালা।একজন গিয়ে ততোধিক উৎসাহী হয়ে চা বানাল।এখন বলে উঠল  -- শালা, চা করতে জানিস ? যা চা হয়েছে দেখছি, মনে হচ্ছে তাতে দিতে আর কোন কিছুই বাকি নেই। শালা, চায়ের এমন স্বাদ যেন পাঁচ ফোড়ন ,জিরে, ধনে সব দিয়ে দিয়েছে --- এক বিতিকিচ্ছিরি যাচ্ছেতাই স্বাদ ! তাহলে এত কষ্ট করে চা করার কি দরকার ছিল ? যা হোক,তখন চায়ের সাথে বিস্কুট কি জুটল জানেন ? এখনকার মতো সহজপ্রাপ্য নামী ব্রিটানিয়া বিস্কুট নয়,তৎকালীন বিখ্যাত ' ভগবতী ' বিস্কুট। সত্যিই ,মেসের এই ভগবতী দের জন্য ওই ভগবতী বিস্কুট ই সেরা।একজন ত বলেই উঠল --" আজকে আমরা সবাই ভগবতী। কার্তিক মাস। নেহাত পাশের গাঁয়ের লোকেরা খোঁজ রাখে না। না হলে আমাদের সকলের শিংয়ে ( থুড়ি মাথায়) ধান শিসের টোপর আর কপালে সিঁদুর লেপে দিয়ে দেখাত যে ভগবতী দিগকে দুনিয়ার মানুষ বেশ সুখেই রেখেছে।
  সত্যিই ,ওই জমাটিয়া ভদ্রলোককে আর যাই বলেন, তাতে তাকে অন্ততঃ খেজুরে আলাপের মানুষ কোনো ভাবেই বলা যায় না।

No comments:

Post a Comment