"সন্ধ্যার আলো"
--পৃথা ব্যানার্জী
***************
রিনি ম্যসেজ টা পড়ে চমকে উঠলো। এ কি কথা লিখেছে!
---"কি হলো, উত্তর দেবেনা"? টুং করে ম্যাসেজ এলো।
রিনি ভেবে পাচ্ছেনা কি লিখবে। কথা বলতে ভালো লাগে তাই কথা বলেছে। কিন্তু তাই বলে!
সুরজিৎ চ্যাটার্জীর সাথে আলাপ আজ পনেরো দিন। এক সন্ধ্যায় ফেসবুকের পাতায় বন্ধুত্বের আবেদন নিয়ে সুরজিৎ এসেছিল। রিনির মধ্যবয়সী নিঃসঙ্গ মন সাড়া দিয়েছিল সুরজিতের ডাকে।
---"ম্যাডাম কি এখনও ভাবছেন"!
আবার একটা ম্যাসেজ।
কি লিখবে রিনি ভেবে পাচ্ছেনা। এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে রিনি সুরজিতের প্রতি। ভীষন ইচ্ছে করে কথা বলতে। কথা বলার কায়দাও খুব সুন্দর ভদ্রলোকের। নিজের জীবনে তো কখনও ভালোবাসার স্বাদ পায়নি রিনি। কষ্ট অপমান লাঞ্ছনা নিয়েই তার জীবন।
আবার একটা ম্যাসেজ!
---"আমরা কি বন্ধু হইনি এখনও! যদি হিসেবে ভুল না করে থাকি তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের বয়স পুরো পনেরো দিন।
আমার মনে হয় একটা বন্ধুত্ব পনেরো দিনে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায়। তখন তার ভালোলাগার কথা সে বলতে পারে। আমিও তাই বলেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করে ফেলেছি"।
রিনি তাড়াতাড়ি টাইপ করলো,---"না না ভুল কেন"!
---"ভুল যদি নয় তাহলে উত্তর পাচ্ছি না কেন? বুঝেছি, টাইপ করে কি আর এতো কথা হয়!
নম্বর টা দিয়ে রাখলাম। যদি তেমন অসুবিধে না থাকে তাহলে তোমার টা দাও"।
রিনি অত্যন্ত সাধারণ আর লাজুক মেয়ে। প্রথম জীবনে প্রেম করতে পারেনি। যখন রঙিন স্বপ্ন দেখার সময় তখন মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করেছে। আর এখন তো শুধু "দিন গত পাপ ক্ষয়"!
মনের কোনে একটু যেন সুরের ছোঁয়া লাগলো। মন বললো সেই জীবনটাই যে বৃথা যে জীবনে বসন্ত আসেনি। জীবনের খাতার খোলা পাতাগুলো হোক না একটু এলোমেলো। সাদা কালো পাতায় ছড়িয়ে পড়ুক লাল, হলুদ, সবুজের ছোঁয়া।
শেষ পর্যন্ত মনের কাছে হেরে গিয়ে নম্বরটা দিয়েই ফোন অফ করলো।
এই বয়সেও একরাশ লজ্জা রিনিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। তাহলে এই কি সেই প্রেম, সেই ভালোলাগা! যার স্বাদ সে পেলো জীবনের শেষপ্রান্তে এসে!
গরীব স্কুল মাষ্টার বাবার খুবই সামান্য আয়ে তারা দুই ভাই বোন বড়ো হয়েছে। চাপা লাজুক স্বভাবের জন্য প্রেম পিরিত আর হয়ে ওঠেনি। কলেজে পড়া শেষ হবার আগেই বিয়ে দিয়ে বাবা মা নিজেদের দায় মুক্ত করে ফেলেছিলো। বিরাট অবস্থা না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলো সেই সংসারটা। কিন্তু ছিলোনা শান্তি। উঠতে বসতে গরীবের মেয়ে, ভিখিরির মেয়ে কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল। তবুও সব সহ্য করে দিন চলছিলো। অসহ্য লাগলো তখন, যখন তার স্বামী গায়ে হাত তুলতে লাগলো।
দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে করতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো রিনির তখন সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠিক করলো বাঁচতে হলে মানুষের মতোই বাঁচবে। নাহলে মরবে।
সে বেড়িয়ে পড়েছিল রাস্তায় কোনোও উদ্দেশ্য না নিয়ে।
----"ক্রিং --- ক্রীং ---"
অনেক পেছন থেকে রিনি ফিরে এলো ফোনের শব্দে। অচেনা নম্বর!
---"হ্যালো,
---"এতোক্ষণ অপেক্ষা করে করে আমিই ফোন করলাম। রাগ হয়নি তো"!
---"না, রাগ করবো কেন"! কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে কথাগুলো বললো রিনি।
---"আমি সকালে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর পাইনি এখনও"।
---"আমরা দুজন মধ্য বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেক দিন। ভালোলাগা ভালোবাসা এইগুলো তো ছেলেমানুষী। থাকনা এখন"।
---"ভুল, বয়েস হলেই বুঝি চশমা পড়ে গম্ভীর হয়ে থাকতে হবে! যে কটা দিন বাঁচবো আনন্দের সঙ্গে বাঁচবো।
রিনি তোমার মধ্যে একটা দুঃখের ভাব আছে সেটা বুঝেছি কিন্তু জানতে চাইনি। আজ বলবে"?
---"আমার জীবনে তেমন কিছুই নেই যা কাউকে বলা যায়! জিবনটা শুরু হতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে থেমে গেছে"।
---"সেই হোঁচট খাওয়া পর্যন্তই বলো। তারপর আমি হাত ধরে নেবো। অবশ্যই যদি হাতটা বাড়াও"!
---"নির্ভরতার হাত সবাই ধরতে চায়, কেউ পায় কেউ পায়না"।
সুরজিৎ তাকে সময় দিয়েছিল ফেলে আসা সময়টাকে তার সামনে তুলে ধরতে।
রিনি বাড়ি থেকে সেদিন বার হয়ে কোনোও চিন্তা না করেই শিয়ালদহ স্টেশনে এসে একটা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে বসে পড়েছিলো। চেকার যখন টিকিট চাইলো তখন সে বুঝতে পারলো কি ভুল সে করেছে। তবে এইটুকু নিশ্চিন্ত যে চেকার ধরে নিয়ে গেলে থাকা খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর চিন্তা থাকবেনা।
রিনি যখন চেকারের সাথে যেতে তৈরি তখন সামনে বসা এক বয়স্কা মহিলা রিনিকে বললেন যে রিনি তাদের সঙ্গে যাবে।
---"আপনি আমার মতো একজন অচেনা মেয়েকে কেন নিয়ে যাবেন"! অবাক হয়ে রিনি বললো।
---"আমি মানুষ চিনি। আমার বাড়িতে অসহায় বুড়ো বুড়িদের রাখি। কিন্তু এখন একলা আর পারছিনা। তাই চাইছিলাম একজন নির্ঝঞ্ঝাট কাউকে যে ওই অসহায় মানুষদের নিজের মনে করে ভালোবাসবে। তাই আমি চাই তুমি যাবে আমার সাথে"।
পাল্টে গেল রিনির জীবন। প্রায় তিরিশ বছর হতে চললো এই "আশীর্বাদ" ভবনে।
এখন রিনি এই পরিবারের সর্বময়ী। তবে আগের মতোন আর কাজ করতে পারেনা। তাই দুজন মেয়ে আছে সকলের দেখাশোনা করার জন্য।
অনেকটাই অবসর এখন আর সেই অবসর সময়টা নিজের মতো কাটাবে বলে ফেসবুকে ঢুকে পড়েছে।
রিনি কথাগুলো সুরজিৎ কে বলে চুপ করলো।
---"রিনি আমি অনেকটাই এইরকম ধারনা করেছিলাম তোমার সম্বন্ধে। এইবার তো বলো কতখানি ভালোলাগা তোমার আমার সম্বন্ধে"।
---"একজন নিকট বন্ধুর প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা দুটো শব্দই আমার কাছে নতুন। জীবনে এই প্রথমবার শব্দ টা শুনলাম"।
---"পেছনের সব ব্যাথা ভুলে যাও । আজ থেকে আমি তোমার পাশে"।
সেদিনের পর থেকে রিনি অনেকটা সহজ হয়ে গেল সুরজিতের কাছে। সুরজিৎ তার ফাঁকা মনটাকে ভরিয়ে দিয়েছে।
একদিন এক ভোরবেলায় একটা পাখির শিস রিনির ঘুম ভাঙিয়ে দিল। চোখটা খুলে দেখলো জানলায় বসে কি সুন্দর একটা হলুদ পাখি। খুশিতে ভরে উঠল রিনির মন।
---"দিয়ে গেনু বসন্তের এই গান খানি ----"
চোখ বন্ধ করে রিনি গাইতে লাগলো। এমন সময় টুং টাং করে ফোনটা -----
---"চোখ খুলেই তোমার কথা ---
---"কি কথা --
---"তোমার কথা মনে পড়লো। তাই তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু বলো তো কোন রাস্তায় কিভাবে যাবো"?
একটু ইতস্তত করে রিনি ঠিকানা টা বললো।
বিকেলের নরম রোদে যখন সবাই বাগানে ঘুরছে তখন এক ভদ্রলোক আশীর্বাদের গেট খুলে দাঁড়ালেন।
---"কাকিমা মনে হয় একজন সদস্য বাড়লো" রিনির পাশে দাঁড়ানো স্বপ্না আস্তে করে বললো।
রিনি এগিয়ে এসে বলল,
---"এসো আমাদের আশীর্বাদে"।
সুরজিৎ বললো,---"তুমি একদম অন্যরকম তোমার ছবি থেকে। ইউ হ্যাভ এ নাইস প্রিটি লুক। আচ্ছা আমাকে চিনলে কি করে? প্রোফাইল ছবিটা তো একটু অন্য রকম"।
---"তোমার কথা বলার স্টাইল ছড়িয়ে আছে তোমার মুখে। তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি"।
সুরজিৎ চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,
---"খুব সুন্দর শান্তিময় পরিবেশ। এই জন্যই আমাদের পুর্ব পুরুষরা বানপ্রস্থের পরামর্শ দিয়েছেন"
---"খুব একটা দুর নয়, তুমি আসলে ভালো লাগবে সকলের"।
---"আর তোমার"! খুব আস্তে ফিসফিস করে কথাগুলো বললো সুরজিৎ।
---"জীবনে নিজের করে কখনও কাউকে পাইনি। তুমি আমার প্রথম ভালোলাগা তাই তোমার আসা আমার কাছে খুব আনন্দের"।
---"তুমি আমার সন্ধ্যার আলো। জীবনের সন্ধ্যায় তোমাকে পেয়েছি"।
রিনি সুরজিৎ কে নিয়ে বাগানের দিকে যেতে যেতে বললো,---"এই সন্ধ্যের সময়টা একটু গান কবিতা গল্প হয়। আসলে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একটু মনোরঞ্জন"।
---"তাহলে আজকের অতিথি হিসেবে আমি প্রথম গাইবো। নাইবা হলো সুর তাল ছন্দের মিল।
---"এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু----
রিনি মনে মনে বললো,
---"সত্যিই আমি জড়িয়ে পড়েছি তোমার বন্ধনে"।
copyrights P Banarrje
-----------------------------------
শ্রীমতি পৃথা ব্যানার্জী
কবি-লেখিকা ও আবৃত্তিকারব
দক্ষিন বারাসাত, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ
-------------------------------------
Voice Literary Blog
Editor - Bijoy Sarkar
..... Chief Organizer.....
Chandan Mahanta
Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice------------------