Saturday, 7 March 2020

Poem

Life- A Battle
     ---Anuska Bhattacharya  

Deep inside where nothing’s fine, I’ve lost my mind
  Monsters  don’t sleep under my bed, they scream inside of my head
Why does it always rain on you ?”
I smile all the time so that nobody knows
I sleep to escape from reality
Everything is a battle, every breath is a war, and I don’t think i’m winning anymore
Death seems more inviting than life
I just remind myself
I’ll be alright. One day. Someday. Just not today 


copyrights@ A  Bhattacharya 

------------------------------------------------------------

Anuska Bhattacharya
Poet 
Howrah, West Bengal, India
--------------------------------------------
Voice Literary Blog 
Editor - Bijoy Sarkar 

  .......... Chief Organizer......... 
          Chandan Mahanta 

Voice Literary-Cultural Organization   
---------------------------voice--------------------------

Thursday, 5 March 2020

🌹উপন্যাস আলোচনায় শ্রীমতি প্রিয়াঙ্কা সরকার🌹

"চক্ষুষ্মতী গান্ধারী" (মিহির সেনগুপ্ত) 
--------------------------------------
---আলোচনায় ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে - শ্রীমতি প্রিয়াঙ্কা সরকার 
             

দেখতে দেখতে সময়ের হাতে হাত মিলিয়ে আমি শেষ করে ফেললাম, একটি উপন্যাস " চক্ষুষ্মতী গান্ধারী "।  উপন্যাসটিতে সবটু গান্ধারীর নিজের কথা। এক নারীর জীবনের কথা। দুলে ওঠা সাঁকোর অনেক কথা পড়ে থাকে...  ধুলোয় চাপা রয়ে যায় অবুঝ কানাকানি কথারা৷ যাপিত হয় জীবন...  আজ তাই মাটির নারীর অক্ষেপ বিছিয়ে কথারা...। আমি তাই আলোচনায় নাম দিয়েছিলাম " আমি গান্ধারী বলছি " ; হয়তো এটা আমার স্পর্ধা,কিন্তু বিশ্বাস করুণ আমি সম্পৃক্ত হয়েছিলাম এই কলমে ; মনের গহীনে ক্যানভাসে আঁকা আমার তপোবন ; আজ সাজিয়ে দিলাম ডালি ভরে পাঠক মনে..... #
......🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷................................................

 উপন্যাস আলোচনা: শ্রীমতি প্রিয়াঙ্কা সরকার 

              আমার বয়স তখন কুঁড়িতে যাপন করছে ; হ্যাঁ,  প্রস্ফুটনের সময় তখন আমার। পরিচয়!  আমার মনে ঝড় ; ধলা মেঘে একলোচা নিবিড় আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে ; পিতা আমার ক্ষুদ্র আকারের অধিপতি। আর্যাবর্ত জুড়ে আছে রাজশক্তি প্রধান। কুরু আর পাঞ্চাল ছাড়া সবই তো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র। মনে পড়ছে, চাষার গরু বিকোয় হাটে৷ পূর্ণ হেঁয়ালি বেয়ে, পারস্পরিক সম্পর্ক যে খারাপ নয় ; ছন্দবদ্ধ বিন্যাসে জীবনকে বাঁধতে হবে এ স্বাদ কার নেই! তাই আমি কি ধন্য রাজ্যের পুণ্য সম্পদ হতে পারি, আমি অসুখী আমি অশান্ত। সন্দেহ নেই অন্ধত্ব আমার মানায় না,  তবু যে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে মহাশক্তিধরের শৌর্য প্রদর্শন আমাকেই দেখতে হবে। কি করে ভুলতে পারি,  বাবাজী মহারাজ যে, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তাঁকে। তবে কি  আমার মতের মূল্য নেই! 
কি পাবো আমি!!  রাজমাতা হবো!  কিন্তু কবে, তাও তো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বলবে৷ 

বাবা বলেছিলেন, "আমি যে নারী, স্বাধীন মতামতের
অধিকার সংহিতাসম্মত ভাবে নেই!।  তবে কি পুরুষেরই বলার অধিকার! আমি তবে কি গায়ের জোরে লুন্ঠনের জন্য জন্ম নিয়েছি। কই এগিয়েছে সমাজ!  আর ভুলি কি করে অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকার কথা৷ স্বপ্নেও কল্পনা করতে ভয় হয় যে আমার বক্ষু নদীতে নিমর্জিত হবে; কিন্তু বাক্যালাপ নেই, আলোচনা নেই, কেবল জনশ্রুতি!! না, না কৌলিক অভিমান আর আসে না৷ আহত হবে না, রাজনীতিগত ক্ষমতা বিস্তার৷ আমিও তবে রাজনীতির কুঠারে আত্মস্থ হবো; ডাক জানি না, কূটনীতির আশ্রয় নিতে জানি৷। 

আমি তো প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি সিদ্ধান্তের বুনোট নিবেদনে। ক্ষেমাংকরীর আহ্বানে আমি তখন নিজেই চোখ বেঁধে ফেলেছি, কারণ আমার  তো নারী হিসাবে অধিকার নেই; আমি কি সৌন্দর্যবতী!  না, তিনিও যে আমাকে দেখবেন না। অন্য পুরুষের  দৃষ্টিশক্তি উৎপাদন করবে, এমনটাও যে আমি চাই না। পুরুষ নারীর আকর্ষণ তো নিরর্থক নয়৷ আমার সংযমী শোধনে অনৈতিক সাধনা যে আমি করতে পারি না৷ এটা আমার স্বেচ্ছান্ধতা কারণ। 

আমি সুঠাম, সৌন্দর্যবতী তরুণী। আমি নবীনা, কলাবিদ্যা পারদর্শী ;আমি যে অবধার্য, এড়িয়ে যেতে কি পারি!  আমি যদি ভবির ঘরে পট্টমহিষী না হতে পারি,  তবে আর আমার দুঃখ হবে না, এটা একটু বাহুল্য মনে হয় না!!  ভীষ্ম অধোবদনে মৌন আজ। স্বীকার করলেন, পূর্বে তো নারীর স্বতন্ত্রতা ছিল।
সমাজ প্রয়োজনে পুরুষ এর পরিবর্তন করেছে।  নারীও ক্রমে তা মেনে নিয়েছে। পারস্পারিক স্বার্থবোধ ছুঁয়েই তো এতো স্বতন্ত্রতা, সচেতনতা৷ 

কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তো পাণ্ডুর স্নেহাপদ। বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বলে তো আর দ্বিমত নেই ; এখন ধৃতরাষ্ট্রই রাজা। কালের গতি যে কুটিল৷ তাই "ধৃতরাষ্টকে নিয়ে আপনার মত যে, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নয়, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি"। আসলে আরদ্ধ কৃতকর্ম বন্ধ রাখতে কেউ পারে না৷ বিতর্ক তো শুধু প্রতিযুক্তি দেয়৷ আমাকে তো রাজী হতে হবেই, কিন্তু বলির জন্য আত্মদান কি যথেষ্ট নয়, কিন্তু প্রতিবাদ যে চুপ থাকতে পারে না৷ আমি তো কেবল স্বামীর জন্য নয়, প্রতিবাদী হতেই অক্ষিপট বেঁধে ফেলেছি৷ স্বেচ্ছাচারিতা কখনও যুক্তি হতে পারে না। 

ভীষ্ম কি তবে এমনই আয়োজনে আবদ্ধ। কোনো বিরোধ কি intelligentsia - র cotery মুক্ত হবে না!  বিচ্ছিন্নতা কি গ্রাস করেনা একচ্ছত্র প্রতিপত্তিকে!  শূন্য মাঠে এ কেমন লড়াই সমর্থনের টান।হ্যাঁ, পোষণ করেছেন, যাপন করেছেন বারে বার। কিন্তু,  প্রতিবাদ তিনি চান। লাঘব করতে চান অরাজকতা। আস্ফালনের প্রেম কারই বা ভালো লাগে!অন্তর নিগূঢ় আত্মা যদি প্রজ্ঞাবান উপহার দেয়, তবে তো অমান্য নেশা বাধা মানে না। তাই, ভীষ্মের কথায়, ভবির ঘরে তীর বেঁধে, উপলক্ষ্যে ইপ্সাকে জারি রেখে বরমাল্য হাতে নিলাম। শুভলগ্ন আজ.. ;

আমার ধাতৃকা মাতা ক্ষেমাংকরী ; বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ সে..  আহা! মুখরা বলতে ইচ্ছা হয় আমার। সেই কবে বার্তালাপ প্রাক্কালে আমার ভয় ছিল!  অযাচিত কথার ভঙ্গিতেই আমি বলি হবো না তো!  ক্ষেমাংকরী আমায় মানুষ করেছেন ; গর্ভধারিনীর যন্ত্রণা না হোক পালনেও যে অপত্য প্রেম, তা তো অস্বীকার করা যায় না। পাত্র রাজপদের অধিকারী নয়, জন্মান্ধ..  তাই থাকবে না ক্ষোভ!! তাকে চুপ করিয়ে রাখি কি করে!!  আমার প্রাথমিকের প্রয়োজনীয় শিক্ষায় যে,  তিনিই আমায় যাপন করতে শিখিয়েছেন৷ না, পারি না আমি বোঝাতে! নিরুক্তিতে ভেবেছিলাম আর হয়তো কথার জোড়াতালি দিতে হবে না কথপোকথন, না অঘটন শিহরে এসে গেলো অবসরে৷ ক্ষেমাংকরী বলে ফেললেন, "আমাদের কন্যাটিকে  তাহলে আপনাদের ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে উৎসর্গীত হতেই হলো৷ "

অসহ্য আগ্রহ বললে যে বৈপরীত্য এসে ধরা দেয় কালির আঁচড়ে।  তাই অনিচ্ছাজ্ঞাপন করলে যে, রাজ্য ধুলোয় মিশে যেতো, একথা কি ভীষ্মের কাছে মান্যতা পায় না!  আবার সেই ক্ষত্রিয়ধর্ম প্রকট হয় অধিকারের নামে৷ উঠে এলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু মালিন্য ছুঁয়ে গেলো বাতিল সমাজের পোশাকি নামে৷ ক্ষেমাংকরী দোষারোপ করলেন ভীষ্মকে ; অম্বার জীবনের পরিণতির মূলে ভীষ্মকে দায়ী করলেন৷ অপর দুজন তো বিকৃতকামুক যক্ষারোগগ্রস্থ রাজকুমারকে বিবাহ করতে বাধ্য হলেন,  আহা!  জ্যেষ্ঠভ্রাতা কিভাবে ভাদ্রবধূকে অঙ্গস্পর্শ করে!!  এবার ভীষ্ম পারছেন না৷ এ যে যাজ্ঞবল্ক্য অবস্থা!! উদাসীন মনের কারক হয়ে তো নারীর কাছে হেরে যেতে নেই৷ এবার তাই একাকী পুড়ে নয়,  কালি মাখাতে হবে যুক্তির অসহায়তার মুখে৷ 

তবে শুদ্র রজকিনী তো ধাতৃকা। শূদ্রের অভিজ্ঞতা থাকবে এমন আবার হয় নাকি!  পুড়ন্ত বিকালের মতো ফুরিয়ে যায় অহং। শুদ্র কিন্তু অনভিজ্ঞ  নয়। মাতৃবৎ জ্ঞান যে বড়ো পূর্ণতা দেয় কোলজুড়ে। দুঃখী গাছের ডাল শূণ্য হলেও পূর্ণ করেছে সে আমাকে, সে মায়ের জাত নেই৷ মন্দিরের দেওয়ালে স্তব্ধ আরামে আমার দায়িত্ব যে তিনি। মর্যাদার নিশ্চয়তা আমার ধাতৃমা নয়, শুধুই মা। এখানে ভীষ্ম "দগ্ধবীর্য "কথাটা মেনে নিলেন না।  বিচিত্রবীর্য অতিকামুক ; ক্ষত্রিয়দের নাকি যৌনকামনা এমন বেশী হয়৷ আসলে সবটুকু শোধ বর্ণের গুণ বললে বিচ্ছিন্ন শোকের মতো বুকে তীর বাঁধে৷ ধাতৃমা বললেন, নারীর স্বাভাবিক অধিকারের অমর্যাদার বিরুদ্ধেই তো প্রতিবাদ। আসলে ক্ষেমাংকরী যতই যুক্তিসম্মত কথা বলুক, সে শব্দ তীক্ষ্ম। কিন্তু, ভীষ্ম স্বভাব ভদ্র। 

এখন প্রশ্ন হলো আমি তো নারী।  হঠাৎ ভালোবাসা না হয় আমায় মানায় না, কিন্তু আমি কি স্তব্ধ হবো ছোট প্রাণে। আমারো পিতা মাতা সমানভাবেই আমাকে মানুষ করেছে, তবে কেন!  কেন আমার মনের ঘর ভাঙবে মননে!  শ্রদ্ধাযোগ্য স্বামী, আর বরণীয় সাথী তো আমি পেতাম; তবু   রাজপদে আসীন নয় এমন জন্মান্ধ কে নিয়ে আমায় বইতে হবে!  সে তো নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারী, তাহলে তো সে ইন্দ্রিয়পরায়ণ হবে এটাই সম্ভাবনা ; কিন্তু বিয়ে যে আমাকে করতেই হবে ; কৌরব জ্ঞাতি ও বাহ্লীকরাজ সম্পর্কে ভীষ্ম জ্যেষ্ঠ। এই বন্ধুত্ব যে থাকবেই, এটাই নিশ্চিত৷ সবটুকুই তো রাজনৈতিক বাঁধন৷ আমার পিতাও তো কিংকর্তব্যবিমুঢ় ; সিদ্ধান্ত নিতে বার বার পা সরিয়েছেন। আমিও তাঁর অপারক ভাব বুঝি। আসলে শান্ত মস্তিষ্ক সবসময় বিচারে চলে৷ পিতা আমাকে অমর্যাদা করেননি কোনদিন ; শুধুই অকপট নয় বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছেন গর্জে, শিকড়ে আটকে নিয়েছেন মাটি আমাকে৷ পুত্রের মতো স্থান দিয়েছেন এবং সম্মান করেছেন। আমার স্থিরতা, একরত্তির খেলার আহ্বানের মতো আধখানা সিদ্ধান্ত নয়, তাই ভরসা করেছেন আমায়। পিতার মুখে ইরম্মদের মতো জামাতার আকাঙ্ক্ষাকে ভ্রষ্ট হতে দেখে,  অশ্রুজলে বক্ষ সিক্ত হয়েছে৷ 

ক্ষমতাশীলরা কি এইভাবে আঘাত করে!  ভাগ্য কি কেউ তৈরি করে দেয়!  হ্যাঁ, দিয়েছে তো। ক্ষমতার অলাতচক্র নাকি দৈব্য বিধান, না, আমি মানি না। আচ্ছা!  তবু কি ভবিষ্যৎ গড়ে দেয় বাঁচার আশ্রয় ; নাকি আমার মতো মহাধ্বংসের কারণ গড়ে দেয়। আমাকে যে বর্জন করার ক্ষমতা সমাজ দেয় নি... ; আমি জানিয়ে দিয়েছি তাঁকে, ভালোবেসে নয়,  স্বচ্ছায় বিচার করে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। চেতনা হলো শেষে, টুকরো সুখে বৃহৎ বিসর্জন যে বিধেয় নয়,  সিদ্ধান্তে এসেছি...  আমার কন্যাপণ, উপঢৌকন, কার্পণ্য নয়...  ভীষ্ম রাজি। পিতা অনঢ়! আমরা ত্যাগী হতে পারি, সমর্পণ করছি; এ আমার  সংসার ভূমি, বিকিকিনির হাট নয়, বিচক্ষণ হতে পারি, পাত্রের সৌভাগ্যবতী জীবনসঙ্গীনী।। 

আজ আমি বিবাহে সম্মতি দিয়েছি; বাবা বলেছেন,  সংহিতা রীতি মেনে  রাজপুত্রের খড়্গের সঙ্গে পরিণয় হবে আমার। আপত্তি করিনি আমি, কিন্তু ধাত্রীমাতাকে সঙ্গীনীরূপে পেতে চাই। কেন ভুল বলেছি!  বাবা তো সম্মতি দিলেন আমায়; কন্যাপণ যদি বংশরীতিতে প্রশস্ত হয়, বাবা সম্মতি দেবেন। কৌশিক আচারকে আমরা সম্মতি জানাই তো। পণ মেনে বংশরীতির যাপন আমার কাছে মর্যাদা নয়। মেঘে পাল তুলে ভেসে গেলে উড়ো ছাই হয় অভিসারী ভেলা। দুঃখ শিকারী মনে কেবলই আদেশ মনে হয় ভীষ্মের বাণী৷ তবে আমি ঋণী আজ; ভীষ্ম বলেছেন, জন্মান্ধের অভিশাপে কন্যার পুণ্যবল আমার। নির্জনতাকে অজুহাত দিলে যেমন শোকজব্দ প্রাণ তৈরি হয়, আমারো তেমন স্বতপ্রবৃত্ত স্বতন্ত্রতা জাগে ; 

বেদনাহতের নির্দেশে শকুনী বলেছেন যে, সে ভগিনীর সাথে যাবেন, তবে ক্ষণিকের ঢেউ নয়, নিবিড় আলোড়নের দশমীর মধ্যরাতে ফিরবেন না। স্থিত হবেন সারাজীবন।  ধাতৃমা চাইতেন না যে, আমি ক্ষত্রিয়ানীর বদ্ধমস্তকের আচরণ পালন করি, কিন্তু আমি যে একটিবার স্বামীর মুখ দর্শন করতে চাই। তবে পুত্রের মুখ আমি দেখবো না। ধাতৃমা চেয়েছিলেন আমি যেন মহাপথের আশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শেষবারের মতো দেখি৷ তবে তক্ষশিলা পর্যন্ত আমি গিয়েছি৷ আমার অগ্রজ অক্ষক্রীড়াবিদ। আমায় বলেছিলেন, রথাহোরণে ভ্রমণ নাকি বড়ো সুখকর৷ আমি তো জানি যে, অগ্রজ বিপত্নীক, তবে ক্ষেমাংকরীর সাথে শারীরিক নৈকট্য আছে তাঁর। ক্ষেমাংকরী জানবে না এটা তো হতে পারে না।  ক্ষেমাংকরী এক এক স্থানে পৌঁছে গেছেন,  পরিচয় দিয়েছেন এবং স্বপ্ন ঘোরে মিশে গেছেন প্রকৃতির ঘরে। 

আমি তো অভাগী ; অবেলার বুনো আহ্বান তো প্রকৃতি জুড়ে ঈশ্বরী, কিন্তু তীব্র চোরাস্রোতে আমি শীতল শরীর। নির্জনতা আমার উপাসনা হয়েছে৷ নদী - অরণ্য - বিশাল পর্বতের ব্যাপকতা আজ জীবনে অর্থ হারিয়েছে। আমি যে স্বচ্ছান্ধ বরণ করেছি। আমি মাকে বারণ করেছি ; মা!  তুমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধে আমাকে জর্জরিত করবে না। মহেশ্বরের পূজা উপাসনা করার সময়, তুমি আর আদেশ করবে না আমায়৷ আমার কুরুক্ষেত্র যেতে বড়ো সাধ। শ্রীমুখেই না হয় সম্ভোগ করবো দৃশ্য। জীবনের বেশ কিছু মুহুর্তে স্মৃতিই সম্পদ।

আমি পঞ্চদশী নই,আমি অষ্টাদশী এখন। আমি নানাবিধ শাস্ত্র অধ্যায়ন করেছি৷ আমি আজ বিদুষী মায়ের কাছে। জানি আমি অনিচ্ছায় সাব্যস্ত হয়েছি; তবে মা ক্ষেমাংকরী চাতুরী জানে। তিনি মানসিক ক্লেশ নিবারণের জন্য অর্থহীন লঘু চাপল্য প্রদর্শন করছে। মা আমায় ইরম্মদের রূপের কথা বলেছিলেন, কিন্তু অনুভব  যে প্রয়োজন, এটা উনি ভুলে যান নি। দেহের ভিতর দেহ আমায় টানে। ধাইমা, আমায় চেনে। মায়ের আগল খুললেই  যৌবন নিকুঞ্জে গেয়ে যায় মহাবিহঙ্গ। আমি আজ অসহায় 
বিহঙ্গ৷ মায়ের বিবরণে  শারীরচেতনায় আচ্ছন্ন হয়েছি,  কামার্ত হয়েছি কদর্য জীবদেহে। জানতে চেয়েছি, এমন মহার্ঘ অসুখে কেন মা আমাকে ভাসাচ্ছেন। স্বেদজলসিক্ত শরীর মানসে এ উচাটনের পাঠ কেন দিচ্ছেন তিনি!! তবে কি মা আমাকে যৌবন পথে পদার্পণ করার উপযুক্ত পাত্রী তৈরি করছেন!!  জানতেন তিনি!  আমি কর্কশ নিষ্পেষণে ধর্ষিত হবো৷ ধাইমা বললেন, এ তো পুরাণ খ্যাত। মা জানাতে ভুললেন না, যে, তিনি শুদ্রা ; তাঁর বেদমন্ত্র উচ্চারণে অধিকার নেই। তবে যৌনতা এবং প্রসব করানোর কার্যাবলীতে তিনি পারদর্শী।  তাই মা হয়ে মেয়েকে তো সবটুকু উজাড় করে দেবেন-ই, এটাই যথার্থ। 

আচ্ছা!  মুগ্ধতা শুধু দর্শনেন্দ্রিয় কি ঘটে!  চাইলে কি কামনা দিয়ে পরিচালিত করা যায়!  শৃঙ্গার, চুম্বন, রতিক্রিয়া এইটাই কি ভালোবাসা!  মা!  আকর্ষণ কি প্রেম হতে পারে!  আচ্ছা!  অনুভূতির অর্গল খোলা আছে তো!  তিনি নাকি অনবদ্য পুরুষ ; মা বললেন, আমার মুগ্ধতা নাকি আমার কামনার পথ প্রশস্ত করবে৷ আমাদের সর্বাঙ্গীন মিলন আমাদের সার্থক করবে জীবন, ভালোবেসে।। 

আমার ধাতৃমাতা রসবতী, যথার্থ মার্জিত। তাঁর স্বভাব স্থূল নয় ; স্ববিরোধিতায় তিনি পূর্ণ নন ; তবে কি নিত্য সচল প্রতিবাদ। হ্যাঁ, পঞ্চচূড়ার মন্তব্যটিকে  সবৈব ভাবে অস্বীকার করলেন না, আবার গ্রহণও করলেন না। আসলে আমাকে বয়সের সাথে ইচ্ছার উন্মুখ সাথী করতে চেয়েছিলেন,  তাই নারদ আর পঞ্চচূড়ার চাটুল কাহিনি তুলে এনেছিলেন৷ প্রাচীনকালে দেবর্ষি নারদ সর্বলোক পর্যটন করেছিলেন। ভ্রমণরত অবস্থায় অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দেখে বললেন, "নিতম্বিনী,তোমাকে কিছু বিষয় জিজ্ঞাসা করবো! " নারদকে উত্তর দেবেন না, এমন স্পর্ধা কি হতে পারে!  পঞ্চচূড়া তো পুংশ্চলী ( বেশ্যা), তাই সময়ের সাথে পরিবেশের যোগ হবে এ তো বলাই যায়৷ কামিনীগণ সৎকুল সম্ভব, রূপসম্পন্ন ও সধবা হলেও যে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে। নারী হয়ে নারী প্রবৃত্তির চাটুবাক্য যে স্ববিরোধ, তবু রূপ বিবেচনায় মরা নদীর মরণ ফাঁদে কিই বা আশা করা যায়!! আচ্ছা!  তবে কি দেহপশরায় কেবলই সম্ভোগ! আর এই যে কামোন্মও, এও কি ধর্ম রক্ষা!!  কাষ্ঠ রাশিতে অগ্নি সংযোগ তো তৃপ্তি বিধান নয়, আগুনের গোলা ছুঁয়ে কাঙাল ক্ষুধা!! কি বলবে!  এও কি দোষের একক দাবানল। 

জীবনের রতি তো ধর্ম, এতে লিঙ্গভেদ কেন!  শতেক আলোচনা নিয়েই আমরা কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলাম৷ মা জানতেন,  বিদুর মহারাজ বিচীত্রবীর্যের ক্ষেত্রে মূর্ধজা নামি এক দাসীর গর্ভে, কৌরবকুলের নিয়োগ পুরুষ মহর্ষি বেদব্যাসের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছেন। পরিচয় পেলাম পাণ্ডুর ; তিনি বলিষ্ঠ পুরুষ,  ব্যুঢ়োরোস্ক বৃষস্কন্ধ এবং প্রাজ্ঞদর্শন পুরুষ। তাঁর প্রসার জ্যোতি দর্শককে মোহিত করে। আসলে দৈহিক বলেই কি ভালোবাসা, না শ্রদ্ধা আসে বৌদ্ধিক রূপে। আসলে আমি নিজেও তো জন্মান্ধকে মেনে নিয়েছি, রূপে নয়, ঐশ্বর্যে, রাজমাতার তুল্যমুল্য বোধে৷ মা বললেন, কেবল মূর্ধজা রমণ প্রদানে ঋষি প্রণয় লাভ করেছিলেন। আসলে সাধনা অন্তরীক্ষ খোঁজে শস্যবীজ ঠোঁটে। মূর্ধজার মতো নারীর রমণ যে বিদুরের মতো সন্তানের জন্ম দেয়। মা চেয়েছিলেম আমার সাথে জ্যেষ্ঠ কুমারের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহ হোক। মা এইসময়ের দাঁড়িয়ে বললেন, তাঁর কাছে বর্ণভেদ নিতান্তই একদেশদর্শী এবং অর্থহীন।  মা মানতে পারতেন না যে, মূর্ধজা শুদ্র বর্ণের। কেন!  মহর্ষি দ্বৈপায়নের জন্ম সূত্র কি?  মা তো ধীবর কন্যা। এমন বর্ণবিদ্বেষ কেন!!

এবার আমার বরমাল্য অপেক্ষা। মা বললেন, অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র আমার বর ; কিন্তু ঋতুস্রাবের পর সত্যবতীর অনুজ্ঞায় অম্বিকা ব্যাসের নিকট নিজে না গিয়ে মূর্ধজাকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু আমি বড়ো অবুঝ হই এই ক্ষত্রিয় রীতি নামক সংস্কারে৷ বিদুর তো সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, তবু তিনি রাজপদ হতে বঞ্চিত ; পাণ্ডু শ্বেত রোগে আক্রান্ত এবং পাণ্ডুর রোগে রুগ্ন ছিলেন। তিনি কুৎসিত যৌন ব্যধিগ্রস্থ। মহারাজ বিচীত্রবীর্য স্বয়ং যৌনরোগগ্রস্ত ছিলেন ; আর অম্বিকা ও অম্বালিকাও সেই রোগ বহন করেছেন। কিন্তু আমি এইসব ভাবছি কেন!  আমার ভাবী বর এমন রোগ বহন করছে না তো!  কুন্তী সৌভাগ্যবতী।  সে দুচোখে দেখবে পতিকে আর আমি!  আমি তো অক্ষিপটে আবদ্ধ। আচ্ছা!  আমি কি অসূয়াপরায়ণ হয়ে পড়েছি!  হ্যাঁ, অকপটে বলছি, আমি কোথাও কুন্তী ও পরাশবীর ভাগ্যে ঈর্ষা বোধ করছি। ঈর্ষাশূন্য নারী কি হয়!!  পুরুষও কি হয়!! 

 এই সমাজে শীর্ণ ব্রাহ্মণেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছেন। মনে পড়ছে সত্যব্রতী কথা!  কুরু বংশের ভিত্তিমূল ধরে নাড়া দিয়েছিলেন তিনি। আজও ভাবতে অবাক লাগে,  একজন মহাজননী ঊর্ণনাভের জালে আটকে পড়ে গেলেন৷ ক্ষমতা নিহিত স্বার্থের কি পরিণাম। আজ মনে পড়ছে নিত্য রাত্রির সেই মহাকক্ষ, ধাইমার পুরাণ পাঠ..  আর আজ আমি নর্মসঙ্গীনী রাজার৷ রাজ্যপাঠ, দাস দাসী, সব আমার৷ শুধুমাত্র তিনি চক্ষুষ্মান নয়। তিনি আমার বিলাসের উপকরণে ভোগী।  পরনিন্দা, দল পাকানো ষড়যন্ত্র, এইসব দেখা তাঁর কর্তব্য নয়। তবে ঐশী তিনি, প্রীতি রমণীয় দক্ষ, চাতুর্যের অধিকারী। তবে মায়ের দৃষ্টি আর বোধের ক্ষমতা অমলিন। বললেন পাণ্ডুকে কোনোদিন জন্মান্ধ রাজা রাজ্যপাঠ দেবেন না। আর রাজা ঈর্ষার বীজ উপ্ত করেছেন তিনি, ক্ষেমাংকরী বুঝিয়েছেন। আমি অবাক হলাম, যে ধৃতরাষ্ট্র একশো পুত্র চান। আমি ছাড়াও নাকি নব নবতি সংখ্যক কন্যাকে বিবাহ করবেন তিনি। রাজা, রাজন্যকুল স্বেচ্ছাচারী, সুতরাং কেউ তো বলবার নেই। ভাগ্যিস আমাকে এই শতেক পুত্র জন্মের মতো আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্রয় দিতে হয় নি।  নাম হবে আমার, কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে অসম্ভব এইসব। আমি আজ গৃহস্থ শকট, জিরিয়ে নেবো কাল...  মায়াবী জীবনছায়া৷। 

আমি এবার পট্টমিহিষী। আমার গর্ভে তিনসন্তান, এক কন্যা সন্তান। দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ এবং কন্যা দুঃশলা ছাড়া বাকি সব পুত্রেরা অন্যের গর্ভজাত। সংশয় তো আমার জীবন জুড়েই৷ আমার এক বৈশ্যা সহচরীর কোল জুড়ে তিনি দিলেন যুযুৎসুর মতো সন্তান৷ কি করবো আমি!  এ সমাজে দাঁড়িয়ে স্বামীর পরিতৃপ্তি অহংকার তৃপ্তিই আমার মূল লক্ষ্য৷ আমিও যে নারী ; বৈশ্যা পরিচায়িকা ছুঁয়ে আছে পট্টমহিষীর প্রাণ, তবু সে সূত মাগধি!! এটা ভাবতে অবাক লাগে, নবোঢ়া যুবতীগণকে পাণ্ডুই লুন্ঠন করে আনতেন৷ নিজের হাতে ভোগৈশ্বর্যে ডুবিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে৷ ভীষ্ম মদ্ররাজ শল্যের ভগিনীর সাথে পাণ্ডুর বিবাহ দিলেন৷ বিদুরেও বিবাহ দিলেন ; শুনেছি বিদুর একজন দক্ষ মহামন্ত্রী৷ বুদ্ধি, সাধু স্বভাব, অসামান্য স্নেহতেই তিনি মান্যতা পেয়েছেন। আমার স্বামী অন্ধ, তবু আমি বিদুরকে সম্মান করেছি। আমার পরম সুখ হতো, যদি তাঁকে পেতাম। ভালোবাসার আকর্ষণ নয়, প্রেমের আলোড়নে এ আমার কু সন্দেহ ছিল। আমি খুব সন্দেহ করতাম৷ কুন্তীর সাথে পাণ্ডুর আকর্ষণ,  গভীর সম্পর্কের মেলবন্ধন, উফফ! অসহ্য আমার। আমি ভেবেছিলাম, আমি অনেক কথা বলবো, অনেক আলোচনা করবো, পরিণতি আমি দেখে নেবো। পারলাম না, আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম ;তবে অহং আমার, প্রথম গর্ভবতী আমি আবার ।। 

আজ আমার আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমার কুলের প্রথম গর্ভবতী!আমি রাজমাতা হবো। বিদুরের কাছে পৌঁছে যাক সে খবর। পরিশ্রান্ত পৃথিবীর বুকে এই কুলে আমার প্র‍থম সন্তান হওয়া চাই; আমি মহামান্যা বধূমাতাকে জানাতে চাই যে,  প্রথম জাত সন্তান আমারই ভূমিষ্ট হবে ; কিন্তু ভয় হচ্ছে আমার ; আমরই কি প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হবে!!  কিন্তু ওই যে!  ওই যে কুন্তীও সন্তানসম্ভবা ; আচ্ছা!  নিশ্চয়তা আছে কি!  এতো কম সময়ের ব্যবধানে ঘটনাটি আগে পরে হবে, এমন চিন্তা কি শেষ করে ফেলা যায়!  আমি কি তবে নদীর মতো অভিমান বয়েই যাচ্ছি। ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে সংশয়, আমার মনের স্বাদ তন্নতন্ন করছে ছেঁড়া ক্যানভাস। আমার সন্তান সম্ভাবনার অতিক্রান্ত সময়ের উপর আমি যেন ভরসা করতে পারছি না। কিন্তু, ভবিষ্যৎ কেউ কি বলতে পারে!  

সময়ের শেষে আমিই আজ রাজমাতা। পাণ্ডু তাঁর দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে গেলেন। শুনেছিলাম মৃগয়াদি আর প্রকৃতির অনুপম রূপ বুকে নিতেই তাঁদের যাত্রা। এরপর অনেক সময় চলে গেছে। পাণ্ডু চাইতেন না তাঁদের কেউ রণেভঙ্গ করুক৷ কিন্তু তবুও কি মন মানে!  বটপাতার মতো অক্ষর সাজিয়ে রেখে চলে গেছেন তাঁরা৷ আর তাঁরাই যদি রাজকীয়ভাবে নির্বাহ করতে না পারেন, তাহলে!!  আমি জানি!  আমার স্বামী তাঁকে ঈর্ষা করেন। আমিও ক্ষমতা আর ঐশ্বর্য রেখে ঈর্ষায় দগ্ধ হয়েছি বার বার; হ্যাঁ,করেছি ঈর্ষা, শেখানো ফুলপাতায় নিজেকে ঢাকতে পারি নি,  তবু নির্বেদ প্রাপ্ত পুরুষের বুকে ছুরিকাহত স্পৃহা আমার নেই। শুনলাম কুন্তীর এক ফুটফুটে পুত্র হয়েছে৷ নাম সংস্কার হয়েছে তার,  যুধিষ্ঠির; আমার মনে হয়েছে এই একচ্ছত্র অধিকার কেবল আমার হোক, এটা তো আমার জায়গায় থাকলে সবাই চাইবে ; কিন্তু তাঁদের যে ভালোবাসি না, এটা তো হতে পারে না৷ অন্ধ জোনাকি আমি, অধর চেপে জলে ঝাঁপ যে দেবো সেকি আর বিশ্বাসে বোঝাতে লাগে!  প্রণাম জানাই,  সেই শতশৃঙ্গ শৈলের তাপস জীবনে ব্রতী পাণ্ডুকে ; তাঁদের বিড়ম্বিত করতে চাই না আমরা ; তবে ইচ্ছা হলে ওনারা আসুন, অপেক্ষায় আছি, আমি গান্ধারী৷ 

আমার স্বামীর কুমন্ত্রণাদাতা খলচরিত্রের মন্ত্রী কনিকে আমার ঘৃণা হয়৷ মহারাজের দুর্বুদ্ধির মূলে আছেন তিনি। পাণ্ডুর প্রতি স্নেহানুভূতি আমি অনুভব করি। ওনাদের না ফেরার যন্ত্রণা আমায় ভাবায়৷ আসতে আসতে আমরা জ্ঞাত হলাম, পাণ্ডু ও মাদ্রীর মারা গেছেন৷ জ্ঞাত হলাম ১৬ বছরের যুধিষ্ঠির নীচে আরো ভ্রাতাদের নাম। তারইমধ্যে মাদ্রীর পুত্রদেরও কুন্তী আপন করেছেন। পাণ্ডুর এই না ফেরার শোকগাথা, অকালপ্রয়াণ আমাদের অনাথ করে দিয়ে গেছে বহুকাল৷ সর্বনাশা পিপাসাবরণ করেছে দূর্যোধনের শ্বাস। কনিক, শকুনি, সোমদত্ত বাহ্লীক, পরিপূর্ণ বিষে আমার সন্তান। কৌরবকূল তো অবিমিশ্রিত বর্ণের সম্ভার নয়, বরং মিশ্র কুলের সাজ। আর্য অনার্যের মেলবন্ধন কি ভুলে গেছে সমাজ!  কে আসে নি এই কৌরবকুলের বুকে৷ ধীবর, পাটনী যুদ্ধ করেছে, যৌন সংমিশ্রণে গড়েছে বিশুদ্ধতার উপন্যাস। আমি নারী হলেও বুঝতে পারি, ভেদাভেদের সরসী তীরে যে মেয়েটি একা হেঁটেছিল, সেখানে বিভক্ত নিত্য গল্প হয়ে উঠেছে৷ আচ্ছা! কুন্তীর মতো মানুষও ভ্রাতাদের তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখলেন! আর আমার স্বামী!  তিনি দুর্বলতার প্রতিরূপ পিতা হয়েছেন শতেকবার৷ কামনা, বাসনা, রিপু তাড়নাকে সংযত করতেই তো দম্ভের দাপুটে প্রভাব,তা আজ মৃত ঝড়।। এও কি মানা যায়!! 

মাদ্রী আমার থেকে ছোট্ট, কিন্তু কুন্তী আমার পরম সখী। আমি যখন সব হারিয়েছিলাম, তখন কুন্তী আমায় ছাড়ে নি। আর মাদ্রী আর পাণ্ডুর শরীর যখন হস্তিনাপুরে আসে, আমি তখন তাঁকে ছাড়িনি৷ কিন্তু এই যুদ্ধ, এই পতন সব দোষ দূর্যোধনের!!  অসূয়াহীন সময়ের শরীর তাঁর পিতৃপুরুষেরা পরিচয় দিলেন কই!  আমিও তো মৎসর হয়েছি।আমি রাজমাতার লোভে, আকাঙ্খার গলায় মালা দিয়ে অবুঝ চৈতন্যহীন হয়েছি, আমিও দোষী৷ আমি তো জানতাম কর্ণের কথা। কিন্তু পাণ্ডুকে তো কুন্তী এই কর্ণের সত্যতা যথাসময়ে জানান নি, তাই এই কুললয়, ধ্বংসের মাটি, স্বপ্নকুঁড়ি শেষে বিনাশের ছায়া খুঁজেছি৷ 

কুন্তীর আয়ত চক্ষু, বার্তুল স্তন, প্রশস্ত নিতম্ব কি পুরুষ আকর্ষন করার মতো নয়!!  কুন্তী জানতেন পাণ্ডুর যৌনতা ; জানতেন লোলুপ বহুসন্তানের কামার্ত হৃদয়ের কথা, তবু সেই মুহুর্ত তিনি জানেন যে তিনি দগ্ধবীর্য৷ কুন্তী মা হলেন ; হ্যাঁ, যুধিষ্ঠির বিদুরের সন্তান। তবে তো নারীর স্বাধীন যৌন সম্ভোগের অধিকার দেয়নি সমাজ, কুন্তী মানেননি সেই কথা। তিনি স্বয়ংসিদ্ধা৷ অধিকারের শরীরে কিসের জাত, পূর্ণ কলসের শব্দহীন প্রাণ৷ কুন্তী নিয়োগ পুরুষের কাছে বার বার রতিপ্রার্থনা করেছেন৷ এতো পাণ্ড নিজে তাঁকে চেয়েছিলেন। তুল্যমূল্য হিসাবে ব্রাহ্মণের ঔরসে পুত্র উৎপাদন করাটাই কুন্তীর বিধেয়। পাণ্ডু হীনমন্যতায় ভুগতেন৷ বিদুরের আকর্ষণ তাঁকে একাধিকবার ঈর্ষান্বিত করেছে৷ আমার মনে হয়েছিল কিমিন্দম মুনির মৃত্যু,  পাণ্ডুর অভিশাপ কুন্তী আমাকে বললেও, একথাগুলি মিথ্যা৷ জন্মাবধি পাণ্ডু যকৃৎ রোগে আক্রান্ত৷ আর মায়ের কথা অনুসারে পাণ্ডুর সেইকারণেই অকস্মাৎ মৃত্যু হয়৷ 

কনিক, অগ্রজ শকুনি আর মা ক্ষেমাংকরী ঈর্ষা পরায়ণকারী৷ কুট,  রাজনৈতিক, অভিসন্ধি তাঁদের কব্জাগত প্রাণ। দূর্যোধনের ষড়যন্ত্র চক্র দেখেই আমি মহাধ্বংসের ছবি দেখেছি৷ এতো কুমারী অভিশপের মতো তরঙ্গ বাঁধন৷ যুদ্ধ সংসারের অকাম্যের কর্ম। আমি চাই নি, কিন্তু স্বার্থপরায়ণতা, ঈর্ষা, বিবেকহীন পুত্র প্রেমের পরিণতি ফসল..  আজকের আমি৷ একক ব্যক্তি কোনোদিন যুদ্ধে দায়ী হতে পারে না৷ যুদ্ধ হলো পোড়া বাদুড়ে গন্ধ, আর সংসার পরাগরেণু চাষ৷ সংযমে বোধ, রক্তপলাশের কান্না, বিবেকহীন অশুভ চক্র..  মৃত্যুর অপর নাম।। 

আমার সংসারে প্রতিশোধের প্রতিক্রিয়া কি কেবলই দূর্যোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ!  অদ্যবধি পুষে থাকা অসুখে কি সূর্যাস্ত ছিল না!  প্রতিহিংসায় ভীম কি চক্রের বাইরে রেখেছিল কুন্তী, যুধিষ্ঠির, বিদুরকে।  হ্যাঁ, ছিল একান্তভাবেই সংযত। তবে কি তাঁরা  সংযত প্রচেষ্টা করেছেন চিরকাল!! তবে যে যুদ্ধ বিজেতা বা বিজয়ী পরিণাম!  না,  যুদ্ধের একমাত্র ফল হলো ধ্বংস। এ তো আত্মতুষ্টির কারণ হতে পারে না।  অগণিত মানুষের নিহত প্রতিহিংসা, প্রতিদিন দশ হাজার নির্দোষের মৃত্যু, ভীষ্মের প্রতি অস্ত্রাঘাত, জ্ঞাতি দ্বন্দ্বের বিরোধিতা, সবটুকু ছিল নিধন পর্ব। আমরা তো চায়নি এই যুদ্ধ হোক৷ কৃষ্ণ, তুমি পুরুষোত্তম; তোমাকে চেতনার গভীরে ভূর্জপত্র দেবো এ কি আমার সাজে বলো!  তবু তুমি তো শান্তি আনতে পারতে। তুমি কি তবে মূল হোতা ছিলে!  এ তো মোহজাল, যেখানে অজ্ঞানতার অভাবে জড়িয়ে পড়েছে দ্বন্দ্ব। মা বলেছিলেন, কৃষ্ণ এককভাবে কুরু রাজ্য বিভক্ত করার সপক্ষে  মত দিয়েছিলেন। নিরপেক্ষ বিচারে যুদ্ধ সকলেরই কামনা৷ কৃষ্ণ আসলে বুদ্ধিমান ; কৌশলী এবং নেতৃত্বে পরিপন্থী। তিনি জানতেন সংসারে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, 
আর মহাকাল সবকিছুকেই জীর্ণ করে ফেলবেই। আত্মম্ভরী শাসকেরা হতাশায় আকুল হন,কারণ তাঁরা প্রকৃত সত্যকে বোঝেন না।। কেউ আমাকে শেষ তত্ত্বের সন্ধান দিতে পারেননি। তাই প্রশংসা বা নিন্দা একান্তই অর্থহীন৷। 

আজ আর শোকক্লিষ্ট ভাব আসে না। আমাদের  ছিল পুত্রস্নেহান্ধ ভাব ; রাজ্যকামুক ও পররাজ্যলিপ্সা ; আমি পেয়েছি শাস্তি, প্রকৃতিপুঞ্জ থেকে আজ প্রজারা সুখী। বিদুর সজ্জন ছিলেন। তাঁর অভিযোগ  বহুবার সূর্যাস্তের রঙে মিশে গেছে স্নেহান্ধের বুকে। ধৃতরাষ্ট্রের  কাছে পাণ্ডবেরা সন্তানতুল্য। কিন্তু দূর্যোধন যে তাঁর শরীর থেকে জাত। ভীম বরাবর জ্ঞাতিদ্বন্দ্বের দীর্ঘ পরম্পরাকে ভুলতে বসেছিলেন। আমি দূর্যোধনের ধূর্ত ও কৌশলী ভাবকে অস্বীকার করতে পারি না৷ মা আমি, কিন্তু বিষবৃক্ষের ইন্ধন যোগাতে চাই নি। আত্মঘাতী, দ্বন্দ্ব, ভাতৃঘাতী আমার ইপ্সার বিষয় ছিলো না। কবে মানুষ বুঝবে সে কথা - ধ্বংস নয়, নির্মোহ চিন্তন।। 

কি দিয়েছে এই নিধন বিষন্নতা!  দূর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী আজও ভীমের দ্বারা অথবা তার আদেশে অন্যদের থেকে ধর্ষিতা হবার আশঙ্কা পায়। বিকর্ণের স্ত্রী নিতান্তই যুবতী। কোপন ভীম আজও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে তুলেছে। তবে কি এই নারীদের আত্মহত্যাই শেষ পরিণতি হবে!  এই কি প্রজন্ম বিধি। আজ তো বিবেচনায় আর ধৃতরাষ্ট্র নেই। সমাজ জুড়ে বিভীষিকাময় যে ধর্ষক কাহিনি তা কি অদৃষ্ট ভাবতে হবে!  ভীম আজও ভোলে নি দুর্যোধনের বাম উরুতে চপেটাঘাত আর দম্ভের আদেশ। দুঃশাসনের সেই কেশাকর্ষণ আজও ম্লান হওয়ার নয়৷ আজ আমার কষ্ট বিধবাদের জন্য। আমি চাইনা আমার এই দুঃখের সাথী হোক কুন্তী। যদিও কুন্তী মানতে চায় না, যে, এই ছেদ বিপর্যয়ের৷আমার  সঙ্গে এলেন কুন্তী, বিদুর, সঞ্জয় ;
আজ আমি বানপ্রস্থী ; আমার আজ আর অধিকার নেই এতো কথা বলার ; নিদ্রাকর্ষণ করে না আজ ; কথাবার্তা বন্ধ করে নির্বাক থাকলেও মন বিবিধ ভাবনার তাড়নায় ভোগে৷ আজ আমি কেবলই অনুগামী। 

আজ আমরা দুই সখী অদৃষ্টের দাস ; আমি চেয়েছিলাম তাঁর সাথে থাকতে। মা ক্ষেমাংকরী আমায় যত্ন সহকারে কুন্তীর থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন ; আমি আমার স্বামীর অন্ধত্বকে ভালোবাসতে বাসতে, কবে তাঁর পরিবারকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। আমার মানসিক অভিমান গড়ে উঠেছিল তাঁর উপর; আমি বুঝিনি আমিও রাগ করতে পারি, আমারো মন আছে ; আমারো অভিযোগ আছে,আমারো ভালোলাগা আছে ; কিন্তু মহারাজকে অতিক্রম করতে পারলাম কই!  কুন্তী তোমার পাণ্ডু তোমার যৌবনের অনেকটা সময় তো মাদ্রীর সাথে কাটিয়েছেন। স্বাতন্ত্র‍্যপ্রিয় হলেও মর্যাদার কার্পণ্য তুমিও তো করো নি। তুমি যে বিদুরকে ভালোবাসো, এ আমি জানি। তাই শেষ অবধি আমি তাঁকে সঙ্গে রাখবো। যুধিষ্ঠির তো তাঁরই সন্তান। আমি তো তোমার দোষ দেখি না। তুমি যে, আত্মার আত্মীয়রূপে কাউকে পাওনি, সেখানে আমিও দায়ী। 

আজ কুন্তী তাপদগ্ধ, হতাশ কারণ সে যে কর্ণকে হারিয়েছে৷ আমিও শতপুত্রকে হারিয়েছি ; কুন্তী আমাকে অনুনয় বিনয় করেছে, এই মৃত পুত্রদের যেন আমি একবার দেখি৷ আমার উন্মুক্তচক্ষে  আমি তো বিশ্বপ্রকৃতি দেখি নি,আজ অভাগীর  প্রাসাদে দেখবো মৃত সন্তান।আমি তো সর্বহারা নারী৷ কিন্তু আমার মানসিক ব্যাধি থেকে আমিও মুক্ত হতে চাই৷ আমার উন্মুক্ত চক্ষুর দ্বারে ভুঁড়ি ভুঁড়ি অন্ধকার মেপে নিচ্ছে দুঃখ৷ প্রকৃতির সাহচার্যপ্রাপ্ত অবয়বী হয়ে শীতল চন্দন প্রলেপে আমি ছুঁলাম জীবন৷ নিসর্গ তো শান্তির উৎস,  আমার নিঃসঙ্গতা জুড়াবে কি!! আমি ফিরে গেলাম আশ্রমের কোলে। মারণ ব্যাধি ধরে আছে বুক জোড়ায়, আত্মনিমগ্নতা ভালো লাগছে আমার৷ চিত্তশুদ্ধিই তো বৈখাবস ধর্মের মূল কথা৷ আজ কুন্তী আমাকে বোঝালেন কেন তিনি কর্ণ কে মেনে নেন নি৷ সুত আর রাধার উপর অবিচার করতে পারেন নি তিনি৷ আর দুর্যোধন কর্ণকে সব দিয়েছিল, তাই, তাঁকে নিজের দলে নিলে দূর্যোধনের  উপর অবিচার করা হয়, তাই অব্যহতি চেয়েছেন বার বার৷ বিপথগামী হতে গেলে প্রতিপক্ষ প্রয়োজন,মনে হয় ধৃতরাষ্ট্র জুড়েই ছিল সেই কুচক্রীর আসর৷। 

আজ পরিসমাপ্তি কাল উপস্থিত। সম্মুখে বীচিক্ষুব্ধ ভাগীরথী মিলেই আছে মোহবিস্তারে উন্মোচনের পটভূমি। প্রাক্তনদের শরীর নেই, কেবল নিবিষ্টের আত্মনিবিষ্ট মায়া দর্শন। আজ আমি ফিরে যাচ্ছি নিয়তির পোষাকি শোক বয়ে। আত্মস্থ হবো আমি, প্রত্যাবর্তনে আমার কর্তব্য কর্ম। আমার সাথে ফিরলেন না শত পুত্রবধূরা। তাঁদের আর সংসারে ফেরা হলো না। শ্রোতা দর্শকে আমি নিদ্রামগ্ন আজ। ভীম বললেন ঋষি প্রকৃত নির্দয় ; কুল আর কালের শুদ্ধতায় সলিল সমাধি ঘটালেন। ভূমি শূণ্যে আর হাহাকার রইল না, শুদ্ধি পড়ে রইল আয়োজনে নিরন্তর৷।

copyrights@ Priyanka Sarkar  

🌸🌸🌸💮🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
-------------------------------------------------------------

উপন্যাস আলোচনায়:-- 

শ্রীমতি প্রিয়াঙ্কা সরকার 
কবি ও লেখিকা 
বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 
--------------------------------------------------
Voice Literary Blog 
Editor - Bijoy Sarkar 

Voice Literary-Cultural Team
............................voice..........................

🌸🌸🌸💮🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸💮🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸

Monday, 2 March 2020

🌹কবিতা🌹

"সাক্ষাৎ" 
     কবি কৃপাসিন্ধু মাহাত

পেয়েছি আমি তোমারে বন্ধু 
              বহুদিন পর
কত না খুঁজেছি তোমায় 
      পাহাড় পর্বত বনান্তর।
মাতার কাছে করেছি প্রার্থনা 
    বন্ধু আমি অর্হনিশি
হয় তো বা তুমি সেই মোর
     কবিতার পার্থসারথী।
দিলাম কথা তোমায় বন্ধু 
               রাখব তোমার মান
পদ্মা- গঙ্গায় করিলে পার
        করিলে সাহায্য দান।
জপেছি মালা তোমার  নামে  বন্ধু আপন ইষ্ট দেবীর কাছে   
মোর লেখা পাবে প্রকাশ বন্ধু
      শুধুই তোমার আর্শীবাদে।
বলি, সত‍্য যদি থাকে বন্ধু 
      ভগবান যদি থাকে
একদিন মিলিব মোরা বন্ধু 
    বানীর দয়াতে।

copyrights@ K.S Mahata 
--------------------------------------------------------
কবি কৃপাসিন্ধু মাহাত 
পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ
--------------------------------------------------

  Voice Literary Blog 
 Editor - Bijoy Sarkar 

--------------------voice----------------------