প্রবন্ধ
লেখক পরিচিতিঃ যাদব কুমার চৌধুরীর জন্ম ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার চৌকী গ্রামে l প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামে l কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৭৬ সালে রায়গঞ্জ করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে l ১৯৮০ সালে রায়গঞ্জ কলেজ থেকে স্নাতক হন l ১৯৮৩ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজীতে এম. এ. পাশ করেন l হাই স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন ১৯৮৩ সালে l মিল্কী হাই স্কুল, আড়াইডাঙ্গা ডি. বি. এম. একাডেমী হয়ে ইটাহার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন l
সাহিত্যচর্চা কলেজজীবন থেকে l "অঙ্গন" ও "অগ্রণী" নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন l "উত্তরবঙ্গ সংবাদ" দৈনিকে মালদা জেলার প্রতিনিধি হয়ে সাংবাদিকতা করেছেন l সাহিত্য আলোচনায় বিশেষ রুচি আছে l বহু পত্র-পত্রিকায় কবিতা গল্প প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে l "গল্পকথার গল্পগুচ্ছ" ও "গল্পের জাদুঘর" নামে দুটি গল্প সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে "কল্পপথে কাব্যরথে" নামে একটি একক কাব্যগ্রন্থ এবং ২০১৯ সালে "কল্পপথে গল্পরথে" নামে একক গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়েছে l ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে "প্রাসঙ্গিকতায় ভাষা ও সাহিত্য" নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ l
---------------------------------------------------------------------
সত্তরোর্ধ বাংলা উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের গণজাগরণ
সাহিত্য জীবনের দর্পন, সমাজের দর্পন l জীবন ও সমাজের মনুষ্যকৃত শিল্পিত রূপ সাহিত্য বা যে কোনো শিল্পকর্ম l মানুষের জীবনের যতো কিছু সাহিত্যকে অনুপ্রাণিত করে তার মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ একটি অন্যতম বিষয় l যুদ্ধ একটি ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ জিনিস l দীর্ঘদিনের সাধনায়, পরিশ্রমে মানবজাতি যে সৃষ্টি গড়ে তোলে যুদ্ধে তার অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় l যুদ্ধ এমন একটি বিষয় যা উভয়পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে l যারা জেতে এবং যারা হারে - উভয়েই কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় l এবং এই ক্ষতি হয় বহুমুখী l সম্পত্তির হানি হয়, জীবনহানি হয়, জীবনের যে স্বাভাবিক ছন্দ তা বাধাপ্রাপ্ত হয় l মানুষের জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদার যে জিনিসগুলি তার জোগানে বাধা পড়ে l উন্নত জীবনযাপনের যে অনুসঙ্গগুলো সেগুলোও বাধাপ্রাপ্ত হয় l শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাজারব্যবস্থা সবক্ষেত্রে ছন্দ পতন হয় l সর্বোপরি মানবাধিকার হরণ হয় l শোষণ, নিপীড়ন, লুটপাট চলে l নারী নিপীড়ন হয় l বিশেষ করে পরাজিত পক্ষের নারীদের সম্মান সম্ভ্রম লুট করা হয় l এতদসত্ত্বেও যুদ্ধবিগ্রহ হলো সাহিত্যের আঁতুরঘর l পৃথিবীর সকল ভাষাতেই বহু বহু কাব্য মহাকাব্য উপন্যাস যুদ্ধ বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে l শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলি ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত সব যুদ্ধের পটভূমিতেই রচিত l ইংরাজি সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য 'বেউলফ' যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত l বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক আধুনিক মহাকাব্য 'মেঘনাদ বধ' কাব্য যুদ্ধের কাব্য l বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বলতে তলস্তয়ের 'ওয়ার এন্ড পিস', আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘আ ফেয়ারঅয়েল টু দি আর্মস’, ট্রোজানদের যুদ্ধ, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে নাৎসিবিরোধী সংগ্রাম, ফ্রান্স বা রুশবিপ্লব, ভূ-ভারতে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন ও বিপ্লব নিয়েও একাধিক বড় মাপের সাহিত্য রচিত হয়েছে l শিল্পী ও সাহিত্যিকরা বরাবরই স্বাধীনতা পছন্দ করেন, মুক্ত কণ্ঠ পছন্দ করেন, তাই তাঁদের কলম ও তুলি থেকে রচিত হয় সেরা শিল্পকর্ম। একথা সত্য যে যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক, কিন্তু এটাও সত্য যে যুদ্ধের কারণেই আমরা বিশ্ব সাহিত্যের সেরা কিছু উপন্যাস পেয়েছি। এই উপন্যাসগুলোতে মানুষের মুক্তি চেতনা, তাঁর আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
যুদ্ধের প্রভাব যতোই ভয়ংকর ও ক্ষতিকর হোক, তবু মানুষ নিরন্তর যুদ্ধ করে l যুদ্ধ করে মুক্তির জন্য, এমনকি শান্তির জন্য l
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো মুক্তির জন্য লড়াই l
কাদের মুক্তি? পূর্ববঙ্গের মানুষদের মুক্তি l মুক্তিকামী ও স্বাধীনচেতা বাঙালির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের এই যুদ্ধে আমরা প্রিয়জন হারিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি অর্থনৈতিকভাবে, বেছে বেছে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে, নারীর অবমাননা হয়েছে, এসব কিছুই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেশের প্রধান সব লেখকের হাতেই পেয়েছে নতুন মাত্রা।
বিশ্ব সাহিত্যের দিকে নজর দিলে আর একটি বিষয় স্পষ্ট হয় l তা হলো সাহিত্য সর্বদা এক খাতে চলে না l কালের বাঁকে বাঁকে সাহিত্যের নতুন নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজী সাহিত্যে রোমান আক্রমণের ফলে, জার্মান উপজাতিদের আক্রমণের কারণে, তারপরে নর্মান বিজয়, চতুর্দশ শতকে চসারের হাত ধরে ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের পুনর্জন্ম, তারপরেও শেক্সপিয়ার, ক্লাসিকাল ধারা, রোমান্টিক ধারা, ভিক্টোরিয়ান যুগ এবং আধুনিক যুগ এ সবই এক একটি বাঁক। বাংলা সাহিত্যেও এমন বিভিন্ন ধারা বর্তমান। মুক্তিযুদ্ধ এমনই একটি বাঁক l
মুক্তিযুদ্ধ কি ? এক কথায় বলতে পারি একাত্তর সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নয়মাস ব্যাপী অসাধারণ লড়াই, সেটাই মুক্তিযুদ্ধ l এই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য, বর্তমানের গৌরব এবং ভবিষ্যতের প্রেরণা l
এই যুদ্ধের পরিণতিতে একাত্তর সালের ষোলোই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় l নয়মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের নানা অভিমুখ ধরে কবি সাহিত্যিকেরা কালজয়ী সব সাহিত্য রচনা করে গেছেন l রচিত হয়েছে শতাধিক উপন্যাস l সবগুলোই শিল্পের মানে হয়তো উত্তীর্ন হয় নি, কিন্তু যেগুলি হয়েছে সেগুলির সংখ্যাও নেহাত কম নয় l দেশের প্রায় সকল বড়ো লেখক এই কাজে হাত দিয়েছেন l মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে l
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কি দিয়েছে ?
প্রথমত, বাঙালিকে বিজয়ী জাতি হিসেবে সম্মানের মুকুট পরিয়েছে, স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে l মুক্তিযুদ্ধ শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্রে বারবার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনা সাহিত্যকে আলোকিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র ধারার সাহিত্য - মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধকে তাঁদের সৃষ্টিকর্মে তুলে এনেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে পাঁচটি উপন্যাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো l উপন্যাসগুলি নির্বাচন করেছি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র কথাটি মনে রেখে l কোনো উপন্যাসে হয়তো পাক হানাদারদের নৃশংসতার দিক তুলে ধরা হয়েছে, কোনো উপন্যাসে এই নৃশংসতার অন্য একটি রূপ, কোনোটিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এই আভাস পাই এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হচ্ছে, কোনো উপন্যাসে পাচ্ছি নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত ধারাবিবরণী l
যে পাঁচটি উপন্যাস নিয়ে বলবো সেগুলি হলো -
১) রাইফেল রোটি আওরাত’ : শহীদ আনোয়ার পাশা
২) 'নেকড়ে অরণ্য’ : শওকত ওসমান
৩) হাঙর নদী গ্রেনেড’ : সেলিনা হোসেন
৪) 'সাড়ে তিন হাত ভূমি'’: ইমদাদুল হক মিলন
৫) ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ : হুমায়ূন আহমেদ
এই উপন্যাসগুলি সম্বন্ধে বলবার আগে একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে চাই l মুক্তিযুদ্ধ কেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে অনিবার্য হয়ে উঠলো সেই সম্বন্ধে কিছু কথা l মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রায় সকল উপন্যাসেই কথাগুলি ঘুরেফিরে এসেছে l সেই কথাগুলি একটু ঝালিয়ে নেয়া l ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো l একহাজার মাইলের ব্যবধানে একই দেশ দুটো ভিন্ন ভূখণ্ডে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত হলো l কিন্তু ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম দিন থেকে যে বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো, ধারাবাহিকভাবে, তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের দাদাগিরি l রাজনীতি, অর্থনীতি উন্নয়নের প্রতিটি প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করা হলো l পূর্বপাকিস্তানের অপরাধ ছিলো তাঁদের বাংলাভাষার প্রতি প্রীতি l পশ্চিম পাকিস্তানের পাক শাসকদের চোখে বাংলাভাষা ছিলো হিন্দুদের ভাষা l পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমান যারা মাতৃভাষা বাংলার অনুগামী ছিলেন, তাঁরা পাক শাসকদের চোখে সাচ্চা মুসলমান বলে বিবেচিত হতেন না l তাই তাঁদের সাচ্চা মুসলমান করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রচলনের প্রয়াস হলো l পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিবাদ আন্দোলন করলেন l বাহান্নর আন্দোলন সঙ্ঘটিত হলো l ভাষার জন্য আন্দোলনে রক্ত ঝরলো l ভাষার প্রশ্নে পাক শাসকেরা সাময়িকভাবে পিছিয়ে গেলেন l কিন্তু নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে অসুবিধায় রাখা, সমস্যায় রাখা এই অপপ্রয়াস চলতে থাকলো l
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তখনও অনিবার্য হয়ে ওঠে নি l পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি তখনও প্রধান দাবি ছিলো না l এর মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সর্বজনসম্মত বলিষ্ঠ নেতা হিসাবে উঠে এসেছেন l আওয়ামীলীগ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে l নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো l কিন্তু তাকে সরকার গড়তে দেয়া হলো না l এটা ৭০-৭১ সালের গল্প l কিন্তু তখনও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি ভাবনায় ছিলো না l আলোচনা চলছে l সমাধান কিছু একটা হবে দেশবাসী আশায় বুক বেঁধে আছেন l
মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে যে রাতে আলোচনার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে পাক হানাদার সেনা ঢাকা শহরের ওপর আছড়ে পড়লো, মানবিকতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে পাক হানাদারেরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো l রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি ঢুকে পুরুষদের হত্যা করলো, শিশু বৃদ্ধেরাও বাদ গেলো না, টাকা পয়সা, অলঙ্কার, খাদ্যসামগ্রী লুঠ করলো আর মহিলাদের ধরে নিয়ে গেলো ভোগের জন্য l এই নৃশংসতা চললো পরপর তিনদিন l পঁচিশ থেকে সাতাশে মার্চ l বাজার লুঠ করা হলো এবং শেষে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো l রাস্তায়, মাঠে, শিক্ষায়তনে, শয়ে শয়ে লাশ পড়ে আছে, সাংবাদিকদের তাড়িয়ে দেয়া হলো, প্রমাণ লোপাটের জন্য গণকবর হতে লাগলো, সঙ্গে চললো প্রোপাগান্ডা, অপপ্রচার l পাক সেনার নেতৃত্বে বাজার লুঠ হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি ঢুকে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, মহিলাদের তুলে নেয়া হচ্ছে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে, আর পাক শাসকেরা প্রচার করছে এসবই করছে বাঙালিরা, করছে আওয়ামীলীগ - আওয়ামীলীগ দেশকে টুকরো করতে চাইছে, বিশ্ববাসীর কাছে পাক সরকার প্রচার করছে সম্পত্তি রক্ষার জন্য, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে এবং ফলত কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী মারা গেছে l এই নৃশংসতা ও অপপ্রচারের কারণে একটা বিষয় স্পষ্ট হলো এখন আর আলোচনার কোনো জায়গা নেই l সংগ্রামের পথই একমাত্র পথ l মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো l প্রশিক্ষণ শুরু হলো l পাক হানাদারদের ওপর গেরিলা আক্রমণ চলতে লাগলো l ক্রমে সংগ্রাম জোরদার হলো l ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো l নয়মাসের সংগ্রাম শেষে এলো বিজয় l
প্রথম যে উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করবো তা হলো ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ l লেখক শহীদ আনোয়ার পাশা l শহীদ বলা হচ্ছে কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিজয়ের মাত্র দু দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর হানাদারেরা বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে l
সম্ভবত এটি বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে প্রথম l উপন্যাসটি লেখা হয়েছে একাত্তর সালে এপ্রিল মাস থেকে জুন মাস অবধি l অর্থাৎ সেই ভয়ঙ্কর পঁচিশ থেকে সাতাশে মার্চের পরপরই l উপন্যাসটি আত্মজীবনীমূলক l উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন যেন লেখক আনোয়ার পাশারই প্রতিচিত্র। আনোয়ার পাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছিলেন এ উপন্যাস। উপন্যাসজুড়ে যে অনিশ্চয়তা আর মৃত্যু বিভীষিকা খেলা করে তা সত্যি হয়ে উঠেছিল লেখকের জীবনে। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন ২৫ মার্চের পর তিন দিন অবরুদ্ধ থাকে। পাক বাহিনীর ঘেরাটোপে বন্দী সুদীপ্ত এই অস্থির সময় পার করে অপরিসীম বেদনা, শঙ্কা ও অনিশ্চয়তায়। কিন্তু এর মধ্যেও সে অনুভব করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির বার্তা, স্বাধীনতার আগমন ধ্বনি, "নতুন মানুষ, নতুন পরিচয়, এবং নতুন একটি প্রভা l সে আর কতো দূরে l বেশি দূরে হতে পারে না l মাত্র এই রাতটুকু তো l মা ভৈঃ l কেটে যাবে l" ১৯৭৩ সালের মে মাসে প্রকাশ পায় উপন্যাসটি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এই প্রথম উপন্যাসটির জন্য লেখক অমর হয়ে থাকবেন বাংলার মানুষের মাঝে।
এই উপন্যাসের যে শিরোনাম, 'রোটি, রাইফেল, আওরাত' - তার থেকে মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়টিকে এই উপন্যাসে মূলত তুলে ধরা হয়েছে সেটা বোঝা যায় l মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ নয়, পাক সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বর্ননা আছে এই উপন্যাসে l আছে সেই তিনদিনের বীভৎসতার বর্ণনা l লেখক বলছেন পাক বাহিনী আক্রমণ করে প্রথমে বাঙালিদের রোটি অর্থাৎ খাবার রসদ কেড়ে নিচ্ছে, নিজেরা তা খেয়ে বলবান হচ্ছে, রাইফেল দিয়ে বাঙালি পুরুষদের নিধন করছে এবং আওরাতদের তুলে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করছে l সারা উপন্যাস জুড়ে এই নৃশংসতার চিত্র পাই l আর পাই বাঙালি বীরের প্রতিশোধের শপথ l হালিম শেখ বলছেন, "আমাদের ভাইবন্ধুদের ওরা মেরেছে, মা বোনের ইজ্জত নিয়েছে, আমরা তার শোধ নেব l....... খোদার কসম, মায়ের কসম, রক্তের কসম, এর প্রতিশোধ নিব l"
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নেকড়ে অরণ্য’ l লেখক শওকত ওসমান l ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ৬৪ পৃষ্ঠার ছোট্ট উপন্যাস l উপন্যাসে লেখক একটি গুদামঘরের বর্ণনা দিয়েছেন। টিনে ছাওয়া, সমতল মেঝের বিশাল এক গুদামঘর। এই ঘরটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন রেজা খান, আলী খানদের নারী ধর্ষণের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। সে আস্তানায় তানিমা, জায়েদা, রশিদারা ধর্ষিত হয় l কখনো পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের দ্বারা, কখনো বা সাধারণ সৈনিকের দ্বারা। তাদের চিৎকার, আর্তনাদ, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, বিপর্যস্ততার রূপটি লেখক তুলে এনেছেন এ উপন্যাসে। অর্থাৎ এখানেও ফুটে উঠেছে পাক বাহিনীর নৃশংসতার রূপ যা নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিলো l উপন্যাসের শিরোনামে একটি চিত্রকল্পকে তুলে ধরা হয়েছে l নেকড়ে অর্থাৎ পাক সেনাবাহিনী, অরণ্য অর্থাৎ অরণ্যের নিরীহ প্রাণী, এক্ষেত্রে বাঙালি মহিলারা l নেকড়ের মতোই হিংস্র এই হানাদারবাহিনী l তার চেয়েও বেশি l
বনের ভেতর নেকড়ের নৃশংসতাও হার মানে যেন ছোট্ট একটুকরো গুদামঘরে। কিন্তু তার পরও থেমে থাকে না প্রতিবাদ। তানিমা প্রতিবাদ করে
ক্যাপ্টেনের গুলি বুক পেতে নেয় l আত্মহত্যার মাধ্যমে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায় বীরাঙ্গানারা।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ :
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন সেলিনা হোসেন। তার মধ্যে ভীষণ আলোচিত উপন্যাস হলো 'হাঙর নদী গ্রেনেড'। মুক্তিযুদ্ধের এক আবেগী ও প্রতিবাদী উপন্যাস এটি। হলদী গ্রামের এক বয়স্ক নারীর জীবন এই উপন্যাসে মূর্ত হয়ে ওঠে। এই নারী তাঁর নিজের ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যেমন উদ্বুদ্ধ করেন, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে তুলে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। উপন্যাসে এই মায়ের আত্মসংগ্রাম, দেশের জন্য ত্যাগের অপার মহিমা ভাস্বর হয়ে ওঠে।
চতুর্থ উপন্যাস 'সাড়ে তিন হাত ভূমি'’ l লেখক ইমদাদুল হক মিলন l লিও তলস্তয়ের অনুরূপ একটি গল্প আছে l একটি কবরের আয়তন কত? এই প্রশ্নের উত্তর, 'সাড়ে তিন হাত ভূমি'।
উপন্যাসে পাই মুক্তিযোদ্ধা রবি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গ্রামে আসেন পরিবারের খোঁজ নিতে। এসে দেখেন উঠানে পড়ে আছে বাবার মৃতদেহ, ঘরে মা ও বোনের লাশ। আর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর মৃতদেহ পড়ে আছে বাড়ির পেছনে। হতবিহ্বল, অসাড়, অনুভূতিহীন রবি উঠানে নিজ হাতেই খুঁড়ে চলেন প্রিয় স্বজনদের কবর। এবং তার সঙ্গে যেন খুঁড়ে চলেন স্মৃতির গহিন পরিখা। মা-বাবা, বোন, স্ত্রী; এমনকি অনাগত সন্তানের সঙ্গেও তার মিলন হয়, সংলাপ চলে। আর তা দৃশ্যমান হতে থাকে পাঠকের চোখের সামনে। একেবারে অন্য ধরণের উপস্থাপন l প্রতিটি শব্দ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় l
শেষ উপন্যাস 'জোছনা ও জননীর গল্প’ l লেখক কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ l
হুমায়ূন আহমেদ সম্বন্ধে একটু বলি l তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আটটি উপন্যাস রচনা করেন। এগুলো হলো- শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), নির্বাসন (১৯৮৩), সৌরভ (১৯৮৪), ১৯৭১ (১৯৮৬), আগুনের পরশমণি (১৯৮৮), সূর্য্যের দিন (১৯৮৬), অনিল বাগচীর একদিন (১৯৯২) এবং জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প (২০০৬)।
এই আটটি উপন্যাসে ঔপন্যাসিক বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ধরার চেষ্টা করেছেন। শেষের দিকে লেখা 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। এখানে পাই নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য, বিবরণ, ঐতিহাসিক চরিত্র ও তার ভূমিকা ইত্যাদি l নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে উপজীব্য করে লেখক এই দীর্ঘ উপন্যাসটি লিখেছেন । একাত্তরের পুরো ৯ মাসের গল্প পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে। লেখকের চিরায়ত গল্প বলার সৌন্দর্য এ উপন্যাসেও যে পাঠক উপভোগ করেন, তা বলা বাহুল্য।
'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলার এই উপন্যাসে একটি বিষয় আছে যা অন্য মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলিতে নেই, এবং একটি বিষয় নেই যা অধিকাংশ উপন্যাসে আছে l যেটি আছে সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ও আত্মবলিদানের স্বীকৃতি, যা অন্য বহু ঔপন্যাসিক এড়িয়ে গেছেন l কেন এড়িয়ে গেছেন ? হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাসের পূর্বকথা অংশে নিজেই উত্তর দিয়েছেন, "ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছোট করে দেখানোর একটি প্রবণতাও আমাদের আছে l আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও ছোটগল্প পড়ে যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা করতে চায় তাহলে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনী বিষয়ে কিছুই জানবে না l আমাদের গল্প উপন্যাসে বিদেশী সৈন্যবাহিনীর বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত l লেখকরা হয়তো ভেবেছেন এতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের হানি হবে l
ঋণ স্বীকারে অগৌরবের কিছু নাই l মহান জাতি এবং মহান মানুষরাই ঋণ স্বীকার করেন l"
হুমায়ুন আহমেদ লেখক হিসাবে, মানুষ হিসাবে মহান বলেই তাঁর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ও তাঁদের আত্মবলিদানের বিষয়টি যথাযোগ্য মর্যাদায় উপস্থাপিত করেছেন l তিনি তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তার একটি তালিকাও জুড়তে চেয়েছিলেন l তার জন্য সাড়ে পাঁচশত পৃষ্ঠার বইটি আরো একশো পাতার মতো বড়ো হতো l কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নামও থাকতো l কিন্তু পারেন নি কারণ সমস্ত শহীদের নাম তিনি পান নি l যুদ্ধ শেষ হবার তেত্রিশ বছর পরেও সরকার, প্রশাসন সেই তালিকা শেষ করতে পারে নি l এখনও তালিকা তৈরি চলছে l
আর যে বিষয়টি এই উপন্যাসে নেই অথচ অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে আছে তা হলো পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের বিবরণী l লেখক তার কারণ হিসাবে নিজে বলছেন, "আমার এই বইটির অসম্পূর্ণতার মধ্যে একটি হলো আমি পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত নারীদের বিষয়টি আনতে পারি নি l বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর এবং এতই কষ্টকর যে কিছুতেই লিখতে পারলাম না l আশা করছি অন্যরা লিখবেন l তাদের কলমে এইসব হতভাগ্য তরুণীর অশ্রুজল উঠে আসবে l"
হুমায়ুন আহমেদ এই উপন্যাস প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি ইতিহাস লেখেন নি, উপন্যাস লিখেছেন l তবে তিনি চেষ্টা করেছেন ইতিহাসের কাছাকাছি থাকতে, ইতিহাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকতে l বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের দলিলের প্রথম সাতটি খন্ড তিনি পড়েছেন l নিজের বিচার বিবেচনা সাপেক্ষে সেই তথ্য লেখায় এনেছেন l পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি l রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর লেখা 'একাত্তরের দশমাস' গ্রন্থটি থেকেও তিনি তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন l সেই সময়ের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলি তাঁর উপন্যাসে এসেছে l সেই চরিত্রগুলির সৃষ্টিতে প্রয়োজনে তিনি লেখকের স্বাধীনতাও ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে,
"সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো l"
'সাড়ে তিন হাত ভূমি'’ উপন্যাসের লেখক ‘ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদ এর একটি কথোপকথনে হুমায়ুন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে মূল সুরটা কী তার উল্লেখ করেছেন l হুমায়ূন আহমেদ বলছেন একদল মুক্তিযোদ্ধা, যারা যুদ্ধ করছে, তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসা দেশের জন্য এবং দেশের জন্য যে কোনো সময় তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিতে তৈরি- তাদের সেই ডেডিকেশন, সেটাই মূল সুর।
আবার একদল মানুষের কথা তিনি লিখেছেন, যারা যুদ্ধে যেতে পারেনি। একজন খোঁড়া লোক, সে কিন্তু ঘরে বসা, যুদ্ধে যেতে পারছে না। তারপরও তার সমস্ত মন, সমস্ত ইন্দ্রিয়, সমস্ত শরীর কিন্তু পড়ে আছে যুদ্ধের ময়দানে। সে মানসিকভাবে একজন যোদ্ধা। একদল যারা সরাসরি যোদ্ধা, আরেক দল যোদ্ধা, যারা মানসিকভাবে যুদ্ধ করছে। এটাও একটা মূল সুর l
কিশোর উপন্যাস :
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে কিছু কিশোর উপন্যাসও রচিত হয়েছে l মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে এই উপন্যাসগুলিরও ভূমিকা আছে। রাবেয়া খাতুনের ‘একাত্তরের নিশান’, পান্না কায়সারের ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, শওকত ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’,
শাহরিয়ার কবিরের ‘ভয়ঙ্করের মুখোমুখি’, মঞ্জু সরকারের ‘যুদ্ধে যাবার সময়’, ফরিদুর রহমানের ‘দিন বদলের ডাক’, মমতাজউদ্দিন আহমদের ‘সজল তোমার ঠিকানা’ এমন কিছু উপন্যাস l এসব উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পায় । খুঁজে পায় স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কিশোর উপযোগী উপন্যাসগুলি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন।
গবেষণাপত্র : ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস’ : ড. মোহাম্মদ আনোয়ার সাঈদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার সাঈদ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস’ শীর্ষক গবেষণা করেছেন l তিনি দেখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধের উপাদানকে ব্যবহার করে কথাসাহিত্যের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন।’
১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৯ এই যে সময়কাল, এই পর্বে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে থেকে চব্বিশজন ঔপন্যাসিকের সাতান্নটি উপন্যাসকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন।
সেখানে আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, শওকত ওসমানের ‘‘নেকড়ে অরণ্য’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলি আছে l
এই গবেষণাপত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কথাচিত্রের বিবর্তন, বিকাশ, গতিমুখ ও প্রবণতাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোকে তিনি সত্তর, আশি ও নব্বই দশক শীর্ষক তিনিটি অধ্যায়ে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন। উপসংহারে উল্লেখ করেছেন দশকভিত্তিক উপন্যাসের প্রবণতা। তাঁর কথায়,
‘সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন রক্তাক্ত সময় ও সমাজবাস্তবতা, যুদ্ধের বিভীষিকা, ব্যক্তিমানসের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষ বাস্তব অবলোকনই ঔপন্যাসিকদের মানসচিন্তায় ক্রিয়াশীল ছিল।’
‘আশি দশকের মূল প্রবণতায় মুক্তিযুদ্ধোত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার রূপায়ন এবং লেখকদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধকে নানামুখী দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকনের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়।’
‘নব্বই দশকের উপন্যাস রচয়িতারা মুক্তিযুদ্ধের বস্তুগত সত্য উদঘাটনের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ ও জীবনের মর্মসত্য উদঘাটনেই অধিক তৎপর ছিলেন। সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনাই হয়ে উঠে এই দশকের উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।’
সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে অতীতে আরও অনেক গবেষণা হয়েছে। যেমন, আমিনুর রহমান সুলতানের ‘বাংলাদেশের কবিতা ও উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, শহীদ ইকবালের ‘রাজনৈতিক চেতনা: বাংলাদেশের উপন্যাস’, সাহিদা বেগমের ‘কথাসাহিত্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’, নূরুউল করিম খসরুর ‘উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদি অন্যতম।
মুক্তিযুদ্ধ ও পশ্চিমবঙ্গ :
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আলোড়িত করেছে পশ্চিম বাংলার লেখকদেরও। তার মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘১৯৭১’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালে কলকাতার মিত্র এন্ড ঘোষ থেকে প্রকাশিত হয় তারাশঙ্করের এই উপন্যাস।
এখানে উঠে এসেছে পূর্ববাংলায় বাংলাভাষার দাবি, মুজিব প্রসঙ্গ, পুরোনো পল্টনে শ্রমিক ফেডারেশনের মিটিং, ভুট্টোর ঘাড় হেঁট করে ফিরে যাওয়া, জামাতে উলেমার দালালি, আছে দেশে মার্শাল ল জারি, টিক্কা খাঁর কথা, মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকার তৈরির কথা। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার অবস্থান, শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত বাঙালিদের জীবনযাত্রাও উঠে এসেছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "পূর্ব পশ্চিম" উপন্যাসও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছে l
উপসংহার :
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রেরণা। দমিত, দলিত জনগোষ্ঠীর আত্ম-আবিষ্কারের নাম মুক্তিযুদ্ধ। এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নির্মম ও নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে এবং আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তথ্যসূত্র :
১) দৈনিক সংগ্রাম : "বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ : আহমদ মনসুর : শুক্রবার ১৬ আগস্ট ২০১৩, প্রিন্ট সংস্করণ
২) কালের কণ্ঠ ২০ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০
মুক্তিযুদ্ধের ১০ উপন্যাস : মাহমুদ শাওন
৩) বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ : চৌধুরী শাহজাহান শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ :
৪) প্রবন্ধ : বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ : ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর. কম
৫) গবেষণাপত্র : "মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস" - চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার সাঈদ
৬) মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে লিখিত প্রবন্ধে আলোচিত উপন্যাসসমূহ
৭) মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ প্রকাশ: ২০১৭-১২-১৫ ৮:৩৩:৫৮ এএম, মুম রহমান | রাইজিংবিডি.কম
---------------------------------------------------------------------
কবি লেখকদের দায়বদ্ধতা
কবি লেখক লেখেন তাঁর ভেতর থেকে উঠে আসা তাগিদে l সকলে লেখেন না l যারা লেখেন তারাও সবাই একরকম তাগিদ অনুভব করেন না l লেখা একটি সাধনা এবং লেখকভেদে এই সাধনার রকমফের আছে l প্রাথমিকতা একেকজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন l প্রতিভার চরিত্রও বিভিন্ন রকমের l সবাই একরকম হতে পারেন না l দায়বদ্ধ সবাই l কিন্তু একেকজন লেখক একেক রকম দায় অনুভব করেন l বা হয়ত সচেতনভাবে কোনো দায় অনুভব করেন না l এমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখেন l লেখার নানা উদ্দেশ্য থাকে l বিনোদনের জন্য, নির্মল সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য, আবার সচেতনভাবে সমাজ সংশোধনের মানসিকতা নিয়ে l
'ঐকতান' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে দুটো কথা বলছেন l প্রথমে বলছেন
"আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,"
পরের পংক্তিগুলিতেই বলছেন,
"এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-
রয়ে গেছে ফাঁক।"
ঠিক এই সুরেই কবিগুরু তাঁর ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার কথা নানা কবিতায় নানা কথায় তুলে ধরেছেন
'এবার ফিরাও মোরে' কবিতার শুরুতে বলছেন,
"সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।"
একটু পরেই বলছেন,
"এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে, রঙ্গময়ী! দুলায়ো না সমীরে সমীরে
তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায়।
বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায়
রেখো না বসায়ে আর।"
দায়বদ্ধতার প্রশ্নে এই দ্বিধা, সংশয় বরাবর রবীন্দ্রনাথকে ভাবিত করেছে l তুলনায় নজরুল ছিলেন সংশয়হীন l নিজেকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে, "আমি যুগের কবি নই, আমি হুজুগের কবি"। নজরুল বলতে চেয়েছিলেন, যে দক্ষতার গুণে একজন কবি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকেন, সেই গুন তাঁর নেই। তাঁর যেটা আছে সেটা হলো বর্তমান সময়কে ধরে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়ার ক্ষমতা l সেটাই তিনি করে গেছেন।
'আমার কৈফিয়ত' কবিতার অন্তিম অংশে কবি বলছেন,
"বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক' মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে !
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে !
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে ।
প্রার্থনা ক'রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ ।"
তারপরেও কবি নজরুল টিকে আছেন যুগ যুগ ধরে। প্রশ্ন হলো, যদি তাঁর রচনা হুজুগে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তা কেন আজও বেঁচে আছে ? কেন মরে যায়নি ? আর এই হুজুগটাই বা কি ছিলো ?
কবি নজরুলের সাহিত্যচর্চার স্থায়িত্ব ছিল খুব কম, মাত্র চব্বিশ বছর। ১৮৯৯ সালে জন্ম, ১৯৭৬ সালে মৃত্যু, ৭৭ বছরের তাঁর আয়ুষ্কালের শেষ ৩৬ বছর ছিল সৃষ্টিহীন l ১৯৪২ সালে এক ভয়াবহ দুরারোগ্য অসুস্থতার (পিক্স ডিজিজ) মধ্যে দিয়ে নতুন করে কিছু ভাবা বা সৃজন করার ক্ষমতা হারান তিনি l তখন থেকে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি l
তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটা সত্য যে তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর অনেক ধ্রুপদী রচনা রয়েছে l রয়েছে তিন হাজারের মতো গান l
সময়টা ছিল পরাধীনতার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও দাসত্বের। ঐ সময়টার দাবী ছিল এইসব অন্যায়-দুঃশাসনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। তাই তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, গল্প সকল সৃষ্টির মধ্যে এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই সমসাময়িকতার দাবীকেই তিনি হুজুগ বলে অভিহিত করেছেন এবং এই হুজুগের লেখনী দিয়েই তিনি তাঁর সময়কে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়ার চেষ্টা করে গেছেন। তাই নিজেকে হুজুগের কবি বলে অভিহিত করতে তিনি দ্বিধা করেননি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল l ইংরেজ বিদেয় হলো। দাসত্ব গেল ঘুচে। হুজুগ তো আর থাকলো না l নজরুল কি তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন ? কিন্তু বাস্তবে তা ঘটলো না। যত দিন যেতে লাগলো নজরুল ততো বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে লাগলেন বাঙালীর কাছে।
১৯৭১ সালে নজরুলের চাহিদা অনুভূত হলো প্রবলভাবে। যে নজরুলকে দরকার হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগে, ১৯৭১ সালে সেই নজরুলের জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করলো ওপার বাংলায়। নজরুল স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধলেন নির্যাতিত মানুষের মুক্তিতে উদ্দীপনা যোগাতে l নজরুল অত্যাচারী, শোষক রাজা-হটানো বিপ্লবের আর এক নাম । সেই সূত্রে ওপার বাংলায় আরেক প্রস্থ রাজা বদল হলো l স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো l
১৯৭১ এর প্রয়োজনও মিটেছে l প্রশ্ন, তাহলে কি নজরুল অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন ? এর উত্তর হলো, প্রথমত, সমাজ থেকে শোষণ অত্যাচার এখনও পুরোপুরি মুছে যায় নি l যতদিন তা মুছে যাচ্ছে না, ততদিন নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকবেন l
দ্বিতীয়ত, হুজুগের লেখা ছাড়াও নজরুলের প্রচুর ভাল ধ্রুপদী রচনা আছে l তার জন্যই তিনি চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবেন l এছাড়াও যেগুলোকে হুজুগের লেখা বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যেও প্রচুর কালজয়ী লেখা রয়েছে l
আলোচনার মূল বিষয় ছিলো লেখক কবিদের দায়বদ্ধতা l কবি লেখক যে সমাজে বাস করেন, যে সময়ে বাস করেন, সেই সমাজ, সেই সময় কখনো কখনো অস্থির হয়ে ওঠে l বলা যেতে পারে সকল সময়ই কিছু না কিছু কারণে অস্থির l মানুষ যে পেশায় নিযুক্ত থাকেন, মানুষ যে সমাজে বাস করেন সেখানে নিয়ত একটা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাকে চলতে হয় l এই সংগ্রাম আসে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থেকে l যখন পরস্পরের স্বার্থ মেলে না, কোনো এক পক্ষ তার স্বার্থ আদায় করে নেবার জন্য বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে, তার মধ্যে দুর্নীতির পথ, হিংসার পথ থাকে l দুর্নীতি ও হিংসার পথ অবলম্বন করলে যেটা হয় যে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত, সে ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে l বলা যায় পুরো সমাজেরই স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে l
আমাদের বহুত্ববাদী এই যে সমাজব্যবস্থা, সেখানে একটি পক্ষের সঙ্গে অপর একটি পক্ষের সংঘাত লাগলে অন্য বহু পক্ষের আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে l এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রভাব পড়ে l যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি হয়, অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় l এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও আছে l কারণ রাষ্ট্রও একটি পক্ষ l
এমন সংকট যখন দেখা দেয় সেই সময়ে যারা লেখক কবি থাকেন তাদের কলম থেকে বেরিয়ে আসে, প্রথমত সেই সময়ের একটি বস্তুনিষ্ঠ চিত্র এবং দ্বিতীয়ত, তার থেকে মুক্তির পথ l এক্ষেত্রে লেখক, কবিকে সততার সঙ্গে সময়কে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এবং সাহসের সঙ্গে এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাজকে তার সঠিক পথ চিনিয়ে দেবার জন্য লেখনীর কাজ পরিচালনা করতে হয় l
কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি ? আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি বা বিভিন্ন সময়ে চলে থাকি, সেই সময়ে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে l নির্ভয়ে লেখার পরিবেশ নেই l একটা আতঙ্কের পরিবেশ রচনা করা হয়েছে l পত্রপত্রিকা, সংবাদপত্রগুলি যে সঠিকভাবে ও নিরপেক্ষভাবে বিষয়কে মানুষের সামনে তুলে ধরবেন সেই পরিবেশ যেন দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে l সংবাদপত্রগুলি একটি গোষ্ঠীর দখলে চলে যাচ্ছেন l একটা বিশেষ দল ও মতের পক্ষে সমস্ত খবরা-খবর লেখালেখি প্রকাশিত হচ্ছে l প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলিকে দেখা যাচ্ছে তারা যেন এই বিষয়গুলোতে একটি পক্ষ অবলম্বন করছেন l এমন অবস্থায় সত্তিকারের একটা নিরপেক্ষ অবস্থান কবি লেখকদের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে l
এটা কিন্তু একটা বড় সংকট l চারিদিকে অন্যায় অত্যাচার শোষণ নিপীড়ন পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে সেটা একটা সমস্যা l কিন্তু তার থেকেও বেশি সংকট হচ্ছে সেই সংকটকে যথাযথভাবে অন্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারার অক্ষমতা এবং যথার্থ পথনির্দেশ দেবার মত সাহসের অভাব l
এক্ষেত্রে লেখক-কবিদের একটা বিরাট সামাজিক দায়িত্ব আছে এবং এটা চিরকালই দেখা গেছে যে গণ আন্দোলনের পরিণতিতে অত্যাচার শোষণের এক একটি পর্ব যখন সমাজ থেকে মুছে গেছে সেক্ষেত্রে লেখক-কবিদের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল l যে সমস্ত কবি লেখক নিজের সময়ের দ্বারা আতঙ্কিত না হয়ে দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন এবং যথার্থ পথে লেখনী পরিচালনা করেছেন তারাই কালজয়ী লেখক হয়েছেন এবং তাদের লেখাগুলোই সময় ধরে রেখেছে l সময়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে আমাদের মহাসময়ের জন্য লিখে যেতে হবে এবং বর্তমান সময়ের প্রকৃত অবস্থার সঠিক চিত্রন করতে হবে এবং সেই অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বার করতে হবে l সমাজ সংস্কারের জন্য মানুষের মন সংস্কারের প্রয়োজন l তার জন্য কবি-লেখকদের নির্ভয়ে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে l
যখন লেখক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি নিরবচ্ছিন্ন সংস্কারচিন্তা ও কর্ম থেকে সরে আসেন, তখন সেটা সমাজের পক্ষে খুব বড় দুর্দিন। তখন মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দুঃশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মানুষের সামাজিক চরিত্রে সংস্কারপ্রক্রিয়া চালু রাখার কাজটা লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এই কাজ রাজা হটানো বিপ্লবের চেয়েও জরুরী ও উন্নত। একটা সর্ববঞ্চিত জাতি তার বঞ্চনা থেকে উঠে আসার জন্যে যে জিনিসটা লেখক কবিদের কাছে দাবী করতে পারে সেটা আর কিছু না, সেটা তার আবহমান কালের সামাজিক চরিত্রের সংস্কার। সেই সংস্কারপ্রক্রিয়া নিরবিচ্ছিন্নভাবে লেখক কবিদের দ্বারা চালিত হয় l