গল্প
----
অল্প স্বল্প.কল্প গল্প
(১)
বাদুড়ঝোলা হয়েই এলো বাসটা, থিকথিক করছে অফিসযাত্রীদের ভিড়। কব্জি উল্টে ঘড়িতে সময় দেখে বুঝলো, যে করে হোক এটাতেই উঠতে হবে, এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। ছাতাটা ভাঁজ করে ব্যাগ সামলে এগোয় সুমি, পা-দানিতে উঠতে না উঠতেই বাস ছেড়ে দেয়। “সাইড প্লীজ”, “ও দাদা, একটু চাপুন না”, “দিদি, একটু ভেতরে যেতে দিন” বলতে বলতে নিজের রোগাটে শরীরটা নিয়ে সেঁধিয়ে যায় বাসের পেটে। সামনের যাত্রীকে “দাদা, একটু সাইড”, বলেই একটু থতমত খেয়ে যায়, সামনের যাত্রী তার চেনা, তারই এক সময়ের সহপাঠী প্রদীপ্ত। “তুমি!” বিস্ময় কাটিয়ে স্বাভাবিক আলাপচারিতার পর জানতে চায়,
“বিয়ে করেছো?”
“নাহ্, জোটেনি কেউ। তুমিও তো দেখছি আমার মতোই লম্বা ইনিংস খেলছো।”
জবাব না নিয়ে কথা ঘোরায় সে, “এখন কোথায় কি করছো?”
“আপাতত এক পার্টির কাছে যাচ্ছি। তুমি কোথায় কি করছো?” প্রশ্ন করে প্রদীপ্ত।
“ব্যাঙ্কে যাচ্ছি।”
“জব?”
“হুমম। আগের বাসটা ধরি, আজ লেট হয়ে গেছে।”
“এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, তোমার লেট হওয়ার জন্য এই লেট-লতিফের সাথে দেখা তো হয়ে গেল।” জবাব না দিয়ে মৃদু হাসে সুমি। মোবাইল নম্বর বিনিময় সহ হালকা কথাবার্তার পর গন্তব্যে পৌঁছে পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়ে সুমিতা।
(২)
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই মা বলে, “রোববার কয়েকজন আসছে, তৈরি থাকিস।” শুনে মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হ’লেও প্রকাশ করে না কিছু। মাঝে মাঝেই তাকে শো-পিস হয়ে বসতে হয় পাত্রপক্ষের সামনে। বাবা-মাও তাকে বাড়ি থেকে যেন তাড়াতে পারলে বাঁচে। কিন্তু একে হাড় জিরজিরে চেহারা, তায় রঙে মা কালী, মুখটা বিশ্রী নাহলেও দুর্দান্ত সুশ্রী কিছু বলা চলে না, গুণ বলতে গান জানে, কিন্তু হেঁশেল ঠ্যালা বা ঘরের কাজে গান গাইতে পারার কি দরকার! সবমিলিয়ে পছন্দ কারোরই হয় না। যদিও সে নিজেকে ঠিকঠাক দেখতেই মনে করে। নিজের খরচ চালানোর মতো রোজগার করলেও কি হবে, বাবা-মায়ের এক কথা, ‘ভাইয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। দিদি আইবুড়ো থাকার জন্যই তার বিয়েটা হচ্ছে না’। কলেজে পড়াকালীন একবার মুখের ওপরে বলে দিয়েছিল, “তুমি তো আমার চেয়েও কালো”, প্রতিদানে অনেক কিছুই পেয়েছিল, অবশ্যই পেটে নয়, পিঠে। তারপর থেকে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছে নিজের অজান্তেই।
(৩)
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই হয়তো নিয়ম, এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। যথারীতি মায়ের গঞ্জনা সাথে করে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে সুমি। ভেতরের চাপা কষ্টগুলো আপনা থেকেই জল হয়ে উপচে পড়ছে। কখনোসখনো তার মনে নিজেকে শেষ করে ফেলার চিন্তা যে আসেনি তা নয়, কিন্তু বাঁচার প্রবল ইচ্ছার কাছে বারেবারে হেরে গিয়েছে সে। নিজের অতীত-বর্তমান ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় কলেজের কথা, প্রদীপ্তের কথা। চাপা স্বভাবের বলেই হয়তো পরস্পর বন্ধু হ’তে পেরেছিল। সে কিছুটা তারই মতো, বাবার সামর্থ্য ছিল না এমন নয়, কিন্তু পায়নি বিশেষ কিছু। কষ্ট করেই পড়াশোনা করেছে। রেজাল্ট আহামরি হয়নি, জীবনে বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, তবে কিছু করে দেখানোর জেদ ছিল তার মধ্যে। দুজনে পরস্পরের ভালো বন্ধু ছিল ঠিকই, তবে তার বেশি কিছু না। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সুমি।
ব্যস্ততার সকাল আর পাঁচটা দিনের মতোই। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ফুরসত মেলে দুপুরের পর। নিজে মনস্থির করে ফোন করে প্রদীপ্তকে, সে সময় দিতে পারবে জেনে, তাকে বিকেলে আসতে বলে।
(৪)
“কি হয়েছে? সব ভালো তো?”
তার উদ্বিগ্ন প্রশ্ন এড়িয়ে শান্তভাবে সুমি বলে, “কিছু কথা আছে, একটু সময় হবে?” সম্মতি পেয়ে দুজনে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে মুখোমুখি বসে, চায়ের গ্লাস সঙ্গী করে নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বলে সুমি, নীরবে শুনে যায় প্রদীপ্ত। মোটামুটি তার তিক্ত অতীত জানিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে সুমি, মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে আস্তে আস্তে বলে, “তুমি আমাকে গ্রহণ করতে পারবে? কালো-কুচ্ছিত মেয়েটাকে নিজের বলে মন থেকে মেনে নিতে পারবে?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে প্রদীপ্ত, গভীর ভাবনায় ডুবে থাকার পর মুখ খোলে, গম্ভীর গলায় বলে, “কিন্তু আমার অবস্থার কথা তুমি জানো না। আমি বাজারে চায়ের দোকান করেছি, সাথে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বুকিং করতাম। আজকাল সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করে নিজেরাই নিজেদের টিকিট বুক করছে বলে সে কাজও প্রায় বন্ধ। সবে এলআইসির এজেন্সি নিয়েছি বটে কিন্তু পয়সার দেখা নেই। তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোথাও কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু বিয়ে করে তোমাকে খাওয়াবো কি? পরাবো কি? নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়।”
“ঐ দিকটা নিয়ে এখনই ভাবার কিছু হয়নি। আমিও তো একটা চাকরী করি। বিশাল রোজগার না হ’লেও। আমি আর এভাবে পারছি না, তোমাকে ছাড়া আমার আর কেউ নেই যার কাছে হাত পেতে দাঁড়াতে পারি। বন্ধু বলো, সহপাঠী বলো, বা যাই বলো, এমন পরিস্থিতিতে তোমার কথাই মনে হ’ল।”
“বুঝলাম সবই, আমাকে একটু ভাবতে দাও। আজকের রাতটা ভাবি, তোমাকে কাল বলবো।” কথাবার্তা বলে যে যার বাড়ির পথ ধরে, আশা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সকালের অপেক্ষা করতে থাকে সুমি।
(৫)
সকালে খবরটা পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে সুমি। মনে মনে ভাবে, ‘যাক, এতোদিনে এখান থেকে বেরোতে পারা যাবে’। দাবীদাওয়াহীন পাত্র পেয়ে সবাই খুশি, যদিও বাবা-মা কোনোমতে তাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে। ‘বসতে দিলে শুতে চায়’ আপ্তবাক্যটা মেনেই বাবার ইচ্ছা ছিল ঠাকুরতলায় নমো নমো করে দায় সারার, কিন্তু সুমির জেদেই অনুষ্ঠান করেই বিয়েটা হয় শেষ পর্যন্ত। ভরি পাঁচেক সোনাও আদায় করে নিজের পাওনা বলে। সবশুদ্ধ মোটামুটি ভালোয় ভালোয় মিটে যায় কাজ।
আজ প্রথম নতুন বাড়িতে তার পদার্পণ, যেমনটা আশা করেছিল, ঠিক তেমনই সবার মুখে তার গায়ের রঙের আলোচনা। গা-সওয়া কথাবার্তার ধরণ, আমল দেয় না সুমি। বৌভাতের কাজ শেষে রাতে ফুলশজ্জায় প্রদীপ্ত কাছে এলে জনান্তিকে সুমি জানায়, “আমার গায়ের রঙ দেখেও তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছো।” প্রথমবার মন থেকে মাথানত করে সুমি, প্রণাম করতে যেতেই শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে প্রদীপ্ত। তার হেঁড়ে গলায় গুনগুনিয়ে গান ধরে, “সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।” আবেগে আপ্লুত সুমি আলতো করে একটা কিল মারে তার বুকে, তারপর মিশে যায় প্রদীপ্তর চওড়া বুকে। বাইরের আকাশে তৃতীয়ার বাঁকা চাঁদ হেসে চলে আনমনে।।
---------------------------------------------------------------------
শিবাণী মণ্ডল
কবি ও লেখিকা
ঝাড়খন্ড, ভারতবর্ষে
---------------------------------------------------------------
Voice Literary Blog
Editor - Bijoy Sarkar
Sub-Editor - Monowar Hossain
Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice---------------
No comments:
Post a Comment