গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের স্যার বাবাকে বলেছিলেন ,
' পরেশ মেয়েটাকে গান শেখা , গানটা ওর আসে | '
বাবা কোনো উত্তর দেয়নি | শুধু
হ্যাঁ সূচক ভাবে ঘাড়টা নেড়েছিল |
স্যার দিদিকে কী বুঝিয়েছিল কে জানে ;
দিদি প্রায়ই বায়না করত
হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার জন্য
বাবা হেঁসে বলতেন : কিনে দেবো রে মা |
তারপর অনেকগুলি পঁচিশে বৈশাখ আর
বাইশে শ্রাবণ পেরিয়ে গেল
একদিন দিদি খুব গো ধরল |
কেন , কে জানে, বাবার মেজাজ সেদিন চড়ে গেল
দিদির গালে সপাটে এক চড় ,
দিদিকে আর কোনোদিন বায়না করতে দেখিনি |
আমার মা বরিশালের মেয়ে
দাঙ্গার সময় উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছিল
কিছুই আনতে পারেনি , কেবল
একখানা গানের খাতা ছাড়া |
শুনেছি দাদু নাকি ভালো এসরাজ বাজাতেন
রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিল
এ সব অবশ্য মায়ের কাছেই শোনা
মা যে গান জানতেন সেটা কোনোদিনও
আমাদের কাছে বলেনি ,
দিদিই প্রথম আবিষ্কার করেছিল |
একদিন ঝড়ের রাতে মা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিল
' যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে ...'
দিদি চেঁচিয়ে উঠেছিল , ' মা তুমি গান জান ? '
মা দিদির মুখ চেপে ধরেছিল
তোর বাবাকে বলিস না যেন ,
উনি রাগ করবেন |
বাবা গান বাজনা খুব একটা পছন্দ করত না |
গান যে বাবা কেন পছন্দ করত না
তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমি আজও জানি না
হয়তো অভাবের জন্য স্বভাবটা একটু
রঙচটা হয়েছিল ,
অবশ্য এই নিয়ে মায়ের কোনো অভিযোগ
ছিল কিনা জানি না ,থাকলেও
তা প্রকাশ করেনি |
আমাদের বাড়িতে ঢাউস মার্কা একটি
রেড়িও ছিল ,ওটা ঠাকুরদার সম্পত্তি ,
উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা পেয়েছিল |
কারখানা থেকে ফিরে রাত আটটার খবর শুনত
মা দুপুরে শুনত মহিলা মহল , আর টুকুটাকি অনুষ্ঠান ;
সত্যি কথা বলতে কী রেড়িওর ওই ক'টা অনুষ্ঠাই
মায়ের বাঁচার অবলম্বন ছিল |
আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হতো
মূল উদ্যোক্তা মা
বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে
মা কাপড় রাখার ট্যাঙ্ক থেকে গুরুদেবের ফটোটা বের করে
একটা জলচৌকির উপর রাখত |
আমি ফুল নিয়ে আসতাম
দিদি বাটত চন্দন
মা সুন্দর করে গুরুদেবকে সাজাতেন , মালা পরাতেন |
একটা আসনে বসে গাইতেন -
'হেঁ নূতন
দেখা দিক আর-বার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ | '
আমি আবৃত্তি করতাম |
দিদি কিছু বলত না , মা বললেও না |
সেবার পাড়াতে পঁচিশে বৈশাখের প্রস্তুতি চলছে
অন্য বারের চাইতে জমকটা এবার একটু বেশি
অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবার নিমন্ত্রিত
সুলেখা দির কাছে আমি ক'দিন
বীরপুরুষ আবৃত্তিটা দেখে নিলাম |
অনুষ্ঠানের দিন দিদি বাড়ির বাইরে বের হল না |
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরেই
আমি চেঁচিয়ে শুরু করে দিলাম -
' সন্ধ্যে হলো , সূর্য নামে পাটে
এলেম যেন জোড়া দীঘির মাঠে |
ধু ধু করে যেদিক পানে চাই ,
কোনোখানে জনমানব নাই |
তুমি যেন আপন মনে তাই - '
' মা দিদি কোথায় গো ? '
উত্তরের অপেক্ষা না করে
এক দৌড়ে দক্ষিণের বারান্দা ডিঙিয়ে
বীরপুরুষের মতোই দিদির ঘরে |
' তুই আজ গেলি না দিদি ,
দারুণ হলো | আমি বীরপুরুষ আবৃত্তি করলাম |
সুলেখাদি অনেকবার তোর খোঁজ করেছিল |
তুই কেন গেলি না দিদি ?
গেলে খুব মজা হতো |
বনানীদি মায়ের গানটা গাইল -
হে নূতন দেখা দিক আর-বার | '
দিদি কোনো কথা বলছে না দেখে বললাম ,
' কিরে আমার উপর রাগ করেছিস ? '
' না | তুই এখন যা -
আমার মন ভালো নাই | '
আমার আনন্দটা কেমন যেন দমে গেল |
গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে এসে বসলাম |
মা রুটি করছিল |
' জানো মা দিদি আমার সঙ্গে
ভালো করে কথাই বলল না | '
এমন সময় দরজা ঠেলে বাবা ঢুকল |
হাতে বড়ো মতো কি একটা
আলোতে আসতেই দেখা গেল - হারমোনিয়াম |
আমি সুখবরটা দিতে এক দৌড়ে দিদির কাছে
দেখি ঘরটা প্রায় অন্ধকার
প্রদীপের আলোটাও নিভু নিভু
দিদি মেঝেতে শুয়ে আছে |
' দিদি | দিদি | ' দুবার ডাকলাম
কোনো উত্তর নাই
আমি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম - ' মা ' |
মা দৌড়ে এল
' কী রে , কী হলো ? '
' মা দেখো , দিদি কথা বলছে না | '
মা গায়ে হাত দিয়ে কি বুঝল কে জানে !
আমাকে বলল : হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় |
মা আসনটা পেতে বসল
হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে নিয়ে গাইল -
' আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু , বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি , তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে | '
Copyrights@ M Chakraborty
---------------------------------------------------------------
Voice Literary Blog
Editor - Bijoy Sarkar
Sub-Editor - Monowar Hossain
..... Chief Organizer.....
Chandan Mahanta
Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice------------------