"কুঞ্জবনে আঁততায়ী"
নাজির হোসেন বিশ্বাস
============
ল্যান্ডফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজেই চলেছে, “এই কে আছিস ফোনটা ধর তো”, হাঁক দিলেন অরূপ রতন মজুমদার, শৈবাল মজুমদারের বাবা! অবসর প্রাপ্ত পুলিশ অফিসার, তাই তাঁর গলার জাঁক একটু বেশিই!
“হ্যালো কে বলছেন?”
“আমি পাটনা রেল কোয়ার্টার কুঞ্জবন থেকে বলছি, অরূপ রতন বাবু আছেন?” “দাদা বাবু আপনাকে চাইছেন!” এই দুপুর রাতে কে ফোন করছে, বিড় বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে ফোনটা ধরেই, “হ্যালো বলুন, অরূপ রতন মজুমদার বলছি!”
“আপনি যত তাড়াতাড়ি পারবেন পাটনা চলে আসুন স্যার”
“কেন একটু পরিস্কার করে বলুন, প্লিজ! কোন সমস্যা?”
“হ্যাঁ, স্যার, শৈবাল মজুমদার তো আপনার ছেলে, আজ রাতে রহস্যজনক ভাবে,..”
“কি হয়েছে শৈবালের? কোন বিপদ?”
“হ্যাঁ স্যার, শৈবাল মারা গেছেন!”
ফোনটা ঝনঝন করে হাত থেকে খসে পড়লো মেঝেই!
রেলের চাকরির চিঠি নিয়ে শৈবাল দৌঁড়তে দৌঁড়তে মায়ের কাছে হাজির! “মা, মা আমি চাকরি পেয়েছি রেলে!” চাকরি পাওয়ার সংবাদে প্রথমটাই সব্বাই খুশিতে ডগমগ হয়, কিন্তু যখন শুনলো দূরে অজানা জায়গায় ছেলেকে যেতে হবে তখন মা বেঁকে বসেন! একমাত্র ছেলে বাইরে যাওয়ার কথা শুনেই মায়ের মনটা বড্ড ভারাক্রান্ত হয়ে যায়! সব সময় ছেলের ভাবনায় অস্থির, কি খাবে, কে দেখবে! বিদেশ বিভূয়ে ছেলের থাকার কোন অভিজ্ঞতা নেই তাই মায়ের দুশ্চিন্তা একটু বেশি! ছেলের প্রথম চাকরি হলেও স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে শৈবাল! স্বভাবতই মায়ের মন চায়নি দূরে ছেলেকে চাকরি করতে দিতে, কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানে বাবা, মা দুজনেই! অগত্যা ব্যাগ পত্তর বেঁধে শৈবাল বেরিয়ে যায় কর্মস্থল পাটনার উদ্দ্যেশে!
পাটনা ট্রেন স্টেশনে নেমেই শৈবাল হাত উল্টিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল, সবে বিকেল তিনটে বাজে! সময় মতোই শৈবাল পৌঁছে যাবে! ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে মাটির ভাঁড়ে আয়েশ করে এক কাপ চা নেয় টি স্টল থেকে! বেশ বড় মাপের মাটির কাপে চা শৈবাল তেমন খায় নি কক্ষনো! তাই এখানে চা খেয়ে বেশ তৃপ্তি পায় শৈবাল! চা খাওয়ার দু’মিনিটের মধ্যেই একজন যুবক এসে দৌঁড়তে দৌঁড়তে কাছে এসেই হিন্দিতে বলে উঠলো, “ইধার আইয়ে সাব, গাড়িভি তৈয়ার হ্যায়! আপ চলিয়ে জলদি!”
“তুম কৌন হ্যায় ভাই? ম্যায় তো সমঝে নেহি!”
“রনবীর সাব হামকো ভেজ দিজিয়ে, তুমকো লে জানে কে লিয়ে!”
“ও আচ্ছা তুম রনবীর সাব কা নৌকর হু?”
“হা সাব!”
“তব চলিয়ে!” বাইরে বেরিয়ে দেখে একটি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে উঠেই রওনা দিল শৈবাল! তখন প্রকৃতির বুকে বসন্তের ঢল নেমেছে! কৃষ্ণচূড়া পলাশ ফুলে যেন লাল আগুন ঢেলে দিয়েছে! বসন্তের কোকিল একটানা ডেকে চলেছে কুহুউউউ কুহুউউউ করে! একটা দেহাতি বালক তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে চলেছে কুহুউউউ কুহুউউউ! “এই পৌঁছে গেছি সাব, ধীরেছে সাব! আপ যাইয়ে, ম্যায় লটবহর লে আউঙ্গা!”
“আরে শৈবাল এসো এসো, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?” এই হিন্দি বলয়ে এসে এভাবে কেউ পরিষ্কার বাংলায় আপ্যায়ন করবে শৈবাল আশা করেনি! ফলে বেশ খুশিই হোল শৈবাল! “না স্যার কোন অসুবিধা হয়নি! মোহনলাল ভালোই গল্প করতে করতে এলো! ছেলেটি বেশ মজার স্যার!”
“হ্যাঁ মোহন আমাদের বাড়িতে আছে সেই ছোটবেলা থেকে! ওর মা আমাদের বাড়ি কাজ করতো, হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে মারা গেল, সেই থেকে আমার কাছেই রয়ে গেল! বড় বিশ্বাসী ছেলে! কোন কাজ দিলে ঠিক করে তবেই ফিরবে! তোমার চেহারা পোষাকের বর্ণনা দিয়েছিলাম ওকে, দেখ ঠিক তোমাকে চিনে বের করেছে। অসম্ভব বাস্তব বুদ্ধি ছেলেটার! এসো এটা তোমার থাকার জায়গা! চারিদিকে বড় বড় জানালা, এই বসন্তে কোকিলের ডাক, বাগানে পলাশ কৃষ্ণচূড়ার আগুন ধরা রঙ তোমার খুব ভালো লাগবে শৈবাল!”
“জায়গাটা খুব সুন্দর স্যার, আমার বেশ মনে ধরেছে!”
“ঠিক আছে তুমি ওয়াশ করে টিফিন করো, কোন প্রয়োজন হলে বলবে কিন্তু, নো হেজিটেশন ইয়ং বয়!” হাসতে হাসতে আদ্যপান্ত বাঙ্গালী অথচ রাজস্থানী ভদ্রলোক অমল আগরওয়াল সাহেব ভেতরে চলে গেলেন!
শৈবাল কিন্তু নতুন পরিবেশে বেশ মানিয়ে নিয়েছে! আজ সাতদিন হলো অফিসের কাজ, ফাইল বুঝে নিতেই কেটে গেল, আজ একবার মাকে ফোন করে দেখি! বলে ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা কানের কাছে চেপে ধরে নম্বর ডায়াল করলেন, ওপারে থেকে ভেসে এলো, “কে বলছেন?”
“আমি বাবু বলছি!”
“দিদিমা বাবু কথা বলছে, তাড়াতাড়ি এসো” শৈবালকে বাড়িতে সব্বাই বাবু বলেই ডাকে!
“হ্যাঁরে বাবু কেমন আছিস? এতদিন পরে ফোন করছিস, শরীর ঠিক আছে, স্নান খাওয়া ঠিকঠাক করছিস, রাতে ঘুম হচ্ছে?”
“মা, তুমি কেমন আছো? আমি ভালো আছি, কোন অসুবিধা নেই, খুব ভালো জায়গা মা, তুমি একদম চিন্তা করো না, ওষুধ নিয়ম করে খাবে, আর হ্যাঁ, ফুরিয়ে গেলে বিল্লুকে দিয়ে ওষুধ আনিয়ে নিও, কেমন?”
“হ্যাঁ রে বাবু, ওখানকার খাবার খেতে পারছিস? আমার হাতের রান্না না হলে তোর আবার মুখে ওঠে না!”
“হ্যাঁ মা বেশ ভালো খাবার, তুমি চিন্তা করো না, বাবাকে খেয়াল রেখো, আমি এখন রাখছি, আবার পরে কথা বলবো! রাখছি!” রিসিভারটা রেখে ভারাক্রান্ত মনে শৈবলিনী দেবী মন্থর পায়ে এগিয়ে গেলেন!
“কিগো গিন্নী, ছেলের সঙ্গে কথা হোল, কি বললো?”
“আর কি বলবে, কথা শুনেই আমি বুঝেছি, ওখানকার খাওয়া বাবুর পছন্দ হচ্ছে না!”
“তাই বললো বুঝি?”
“তা বলবে কেন? বড় হয়েছে ছেলে, এখন কি আর ছোট আছে, সব বুঝে নিতে হয়, তোমরা অতটা বুঝবে না!”
“ ও আচ্ছা তাই বলো, আমি ভাবলাম”
“তোমাকে আর ভাবতে হবে না, যে ছেলে কোনদিন নিজের হাতে খায় নি, সে নিজের হাতে খেয়ে ভালো থাকবে” বলেই চোখের জল ঝরিয়ে দিলেন এক পশলা!
“আহা কাঁদো কেন গিন্নী, ছেলে বড় হয়েছে, ছাড়তে শেখ, আর কতদিন আঁচলে বেঁধে রাখবে?”
“দাদাবাবু, বাইরে কে একজন আপনাকে ডাকছেন!” বাড়ির কাজের ছেলেটি এসে জানিয়ে গেল!
“কে আবার এখন ডাকছে দেখি!”
“শ্যামলাল ব্যাপারটা কেমন হোল বলো দেখি? আমি আজ দশ বছর ধরে এই অফিসে জুনিয়র পোষ্টে কাজ করছি, আমার প্রমোশন হোল না, অথচ কোথাকার এক ছোকরা এসে চেয়ারের দখল নিল!” অফিসের এ্যাসিস্ট্যান্ট রামকান্ত ধর কথাগুলো বলেই সিগারেট ধরালেন!
“কি করবেন স্যার, সবই তো দেখতে হচ্ছে, আপনার মত যোগ্য মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে!” বলে বাথরুমে চলে গেলেন শ্যামলাল!
“রামকান্ত দা, একটু আমার চেম্বারে আসুন প্লীজ!” ডেকে পাঠালেন শৈবাল বাবু!
“হ্যাঁ বলুন স্যার!”
“এই ফাইলটা একটু চেক করে আপ ডেট করে দিন প্লীজ!”
“আজই দিতে হবে স্যার?” বলে রামকান্ত বাবু দাঁড়িয়ে রইলেন!
“হ্যাঁ আজই, এনি প্রবলেম?”
“না স্যার, বলছিলাম কি, আমার ছেলেটা একটু অসুস্থ, ডাক্তারের কাছে যেতে হোত!”
“ওকে, নো প্রবলেম, কালকেই দেবেন!”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আসছি!”
এমন সময় একজন লোক চেম্বারে গলা বাড়িয়ে বলে উঠলো, “আসবো স্যার?”
“ও ইয়সে আসুন,বসুন!”
“আমি আসলে বীরভূম থেকে আসছি, বীরভূমের লাল সড়ক আমার বাড়ি!”
“ও আচ্ছা, অতদূর থেকে কি মনে করে, বলুন আমি কি সাহায্য করতে পারি?”
“সাহায্য ঠিক নয়, আমি আপনার কাকার ছেলে, বিশাল মজুমদার আমার নাম, বাবার নাম রতিকান্ত মজুমদার! আপনি যখন ছোট, তখন আমার বাবা, মুর্শিদাবাদ ছেড়ে বীরভূম চলে আসেন, আমার তখন জন্মই হয়নি!”
“তাই, তাহলে ক্যান্টিনে চলুন, কিছু খেয়ে নেবে, তারপর কথা শুনবো!”
“দাদা আমি কিছু খাবো না, খাওয়া দাওয়া করেই অফিসে ঢুকেছি!”
“বেশ তো কিছু না খাও, এই গরমে একটু জুশ খাবে চলো, হাজার হলেও ভাই তো, তবে কোনদিন শুনিনি আমার কাকা আছেন বলে!”
“আসলে আমার বাবা একটু খেয়ালী মানুষ ছিলেন, লেখাপড়া না করে যাত্রাপালা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, ঠাকুরদাদার নিষেধ অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন এই নিয়ে মেতে থাকতেন! তাই তিনি বিরক্ত হয়ে বাবাকে তাজ্য পুত্র করেন, সেই থেকে বাবা নিরুদ্দেশ হন, তারপর এঘাট ওঘাট খেয়া মেরে অবশেষে বীরভূমে আস্তনা গাড়েন!”
“আজ দাদা উঠবো, ভালো থেকো!”
“আচ্ছা ঠিক আছে এসো, ভালোভাবে যাও!”
“আচ্ছা দাদা আসছি, তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগলো, আবার এদিকে এলেই দেখা করে যাবো দাদা!”
“শ্যামলাল!”
“বলুন স্যার!”
“রামকান্ত বাবু আসেন নি?”
“না স্যার, আসেন নি!”
“উনার কাছে ফাইলটা আছে, আজ দেব বলেছিলেন, একটু ফোন করে দেখ তো শ্যামলাল!”
“আচ্ছা স্যার দেখছি!” বলেই রামকান্ত বাবুকে ফোন লাগালেন!
“হ্যাঁ স্যার আজকে কি আসবেন না? আপনার কাছে ফাইলটা আছে!”
“না শ্যামলাল, ছেলেটার অসুখটা বেশি হয়েছে, তাই আজ অন্য ডাক্তারকে দেখাবো ভাবছি, স্যারকে বলে দাও, কালকে ফাইল রেডি করে দেব!”
“না স্যার আসবেন না, ফাইল কালকে দেব বললেন!”
“স্যার আসতে পারি?” বেশ সুন্দরী একজন মহিলা চেম্বারে গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো!
শৈবাল টাইয়ের নডটা একটু টাইট করে নিয়ে গুছিয়ে বসেই বলে উঠলেন, “আসুন!”
বেশ সপ্রতিভ সহাস্য, জীন্সের ওপরে একটি সোনালী টপ, ঠোঁটে ব্রাইট লিপস্টিক ঘষা, চোখগুলো টানাটানা, বেশ আধুনিকা মহিলা, প্রবেশ করেই, একরাশ সুগন্ধি ছড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!”
“বসেই বলে উঠলেন, একটু পার্সোনাল স্যার!”
“শ্যামলাল দরজাটা লাগিয়ে দাও, আর কেউ এলে বলবে, স্যার ব্যস্ত আছেন!”
“ওকে স্যার!” বলেই শ্যামলাল মুচকি হেসেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন!
“আমার নাম মিস কঙ্কনা, কঙ্কনা ভাদুড়ী”
ওদের দু’জনের মধ্যে মিনিট দশেক কথা হয় তারপরেই মিস কঙ্কনা গটগট করে শ্যামলালের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যান!
“শ্যামলাল সব গুছিয়ে বন্ধ করে দাও, আমি বেরিয়ে গেলাম!”
“চলুন ওই গঙ্গার ধারে একটু বসি স্যার!”
“গঙ্গার পাড়টা তো বেশ মনোরম,কঙ্কনা দেবী ” শৈবাল বলে উঠলো
“স্যার একটা গিপ্ট এনেছি আপনার জন্য, নিলে খুব খুশি হবো স্যার!”
“না না দিতেই পারেন, কৈ দিন!” বলে হাত পাতলেন শৈবাল বাবু!
“একটা বিদেশি পারফিউম, রাতে সমস্ত শরীরে মেখে শুয়ে পড়বেন, সুন্দর ঘুম হবে!”
“তাই, অনেক ধন্যবাদ!”
“এবার আমরা উঠবো স্যার!” কঙ্কনা দেবী বলে উঠলেন!
রাত তখন বারোটা! ক্রিং ক্রিং করে থানার ফোনটা বেজে চলেছে, একজন হেড়ে গলায় বলে উঠলো, “নমস্কার মুঙ্গের থানা বলছি!”
“হ্যালো আমি রেল কোয়ার্টার কুঞ্জবনের কেয়ার টেকার সুখলাল বলছি, এক্ষুনি এখানে আসতে হবে, একজন রেল অফিসার রহস্যজনক ভাবে মারা গেছেন, আটেন্ড করতে হবে স্যার!”
“আচ্ছা আসছি রাখুন, সান্তা গাড়ি বের কর বেরতে হবে, শালা দেশটা খুন খারাপিতে ভরে গেল!”
পুলিশ অফিসার, সুখদেব রাও ও তার চারজন পুলিশ নিয়ে ঢুকে পড়লেন!
“বুঝলে বিকাশ ছবিগুলো ঠিকঠাক তুলবে, আর জিনিসপত্র যেন একটিও বাদ না যায়! আর পুলিশ পিকেট বসিয়ে দাও, সকাল ছাড়া ডেড বডি তোলা যাবে না”
“ওকে স্যার!”
“আচ্ছা সুখলাল বাবু, আপনি কিভাবে কখন এটা জানতে পারলেন?”
“স্যার আমি নিয়মিতই উনাকে রাত্রি দশটার সময় খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিই! তারপর ঘন্টাখানেক পর একবার আসি জল দিতে, উনি ফ্রেশ জল ছাড়া খান না তাই আগে জল দেওয়া হয় না স্যার!”
“আচ্ছা এখানে ওনার জয়েনিং করা কতদিন হোল? আর এই কোয়ার্টারে আসাই বা কতদিন হোল?”
“স্যার সে সাত মাস হবে, প্রথম থেকেই এই রুমে উনি থাকেন!”
“কোন কোন লোক এখানে আসা যাওয়া করেন?”
“না স্যার এখানে কোন লোক আসেন না, সমস্ত লোকজন অফিসেই দেখা করতেন, কোনদিন এখানে কেউ আসেন নি!”
ভোরের আকাশে লাল আভা, পাখিরা কিঁচির মিঁচির করে ডেকে উঠেছে, দূরে একটি মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে! ভৈরব মন্দির থেকে ভেসে আসছে কীর্তনের সুর! সব মিলিয়ে একটুকরো ভারতবর্ষ!
এমন সময় শৈবালের বাবা মা আত্মীয় স্বজন পৌঁছে গেলেন কুঞ্জবনে! মা শৈবলিনী হাউমাউ করে এসে কেঁদে পড়লেন শৈবালের নিথর দেহের উপর, “আমি তক্ষনি বলে ছিলাম চাকরী করতে হবে না, বিদেশ বিভূই যেতে হবে না, তবুও কেউ আমার কথা শুনলো না”, বলে বুক চাপড়াতে লাগলেন শৈবালের মা!
অরূপ রতন বাবু পুলিশ অফিসারকে ডেকে বললেন, আমি প্রক্তন আই.সি বলছি, আমার ছেলের মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে, সমস্ত রকম চেষ্টা করুন স্যার!”
“আমরা চেষ্টা করছি স্যার, এই ধীমান বডি পোষ্ট মর্টেমের ব্যবস্থা করো!”
পুলিশ অফিসার সুখদেব রাও দুপুরে চেম্বারে বসে বসে ভাবছেন, কোথায় থেকে শুরু করা যায়, এই কেসের রহস্য উন্মোচন তো করতেই হবে!
“সান্তা গাড়ি বের কর, একটু রেল অফিসে যেতে হবে!”
পনের মিনিট গাড়ি চালিয়ে সান্তা পৌঁছে গেল রেল অফিস! “আমরা থানা থেকে আসছি!”
“আসুন আসুন বসুন স্যার!” শ্যামলাল একটা চেয়ার দিলেন বসতে!
“আচ্ছা শৈবাল বাবু তো এই অফিসে চাকরি করতেন?”
শ্যামলাল বলে উঠলো, “হ্যাঁ স্যার, উনি এই অফিসের ইনচার্জ অফিসার ছিলেন!”
“উনার এই আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ কিছু বলতে পারবেন?”
“না স্যার, আমি কি করে বলবো?”
এই অফিসে আর কে কে কাজ করেন?”
“আছেন রামকান্ত ধর এ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, উনি আজ আসেন নি!”
“আপনি কি এই সাত মাসে রহস্যজনক কোন কিছু এই অফিসে খেয়াল করেছেন?”
“অনেকেই তো আসেন অফিসের কাজে, তবে উনার এক ভাই এসেছিলেন দু’বার, আর একজন সুন্দরী মহিলা এসেছিলেন কয়েকবার! বাইরের লোক বলতে এই দু’জনকেই দেখেছি স্যার!”
“অফিসের সবার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন?”
“শৈবাল স্যার খুব ঠান্ডা আর ভদ্রমানুষ ছিলেন, কোনদিন জোরে কথা বলতে শুনিনি, সব সময় হেসে হেসে কথা বলতেন!”
“ভিজিটর্স বুক থেকে ওই দুজন ভাই আর ভদ্রমহিলার নাম ঠিকানাটা লিখে দিন!”
“এই নিন স্যার!”
“ধন্যবাদ আজ আসছি, পরে প্রয়োজন হলে আবার আসবো!”
“স্যার পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট দেখুন!”
“এতো রীতিমত পরিকল্পনা করে খুন” বলে উঠলেন তদন্ত অফিসার সুখদেব রাও! “সান্তা গাড়ি বের কর, আমরা যাবো কুঞ্জবন রেল কোয়ার্টার!”
“আসুন স্যার!”
“হ্যাঁ চলুন শৈবালের রুমটা একটু দেখবো!”
দরজা খুলে ঘরের মধ্যে পা রাখতেই একটা বিদেশি পারফিউমের গন্ধ নাকে লাগলো! একটু খুঁজতেই আলমারির নীচ থেকে একটি পারফিউমের শিশি চোখে পড়লো! “ধীমান এই শিশিটা ফরেনসিকে পাঠাতে হবে!” চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সুখদেব রাও!
“ধীমান আগামী সোমবার এই পাঁচজনকে থানায় ডেকে পাঠাও, তদন্ত ফাইনাল করতে হবে!” বলে একটা নামের তালিকা ধীমানের হাতে ধরিয়ে দিলেন!
“আজ আমরা এক জায়গায় মিলিত হয়েছি, শৈবাল বাবুর মৃত্যু রহস্য উন্মোচনের জন্য, আশাকরি আপনারা পূর্ণ সহযোগিতা করবেন!” চারিদিকে পিন ড্রপ নিরবতা! কোকিলটা এক নাগাড়ে বাইরে ডেকে চলেছে!
সব্বাই চুপচাপ, কেউ কোন কথা বলছেন না! এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন পুলিশের বড় কর্তা ও শৈবালের বাবা অরূপ রতন মজুমদার মহাশয়!
“পুলিশের বড় কর্তা নীলরতন তালুকদার বলে উঠলেন, তাহলে সুখদেব শুরু করো তোমার কাজ!”
“হ্যাঁ স্যার শুরু করি, আমি প্রথমেই রামকান্ত ধর মহাশয়কে বলছি, বলুন আপনার কি বলার আছে?”
কাচুমাচু করে রামকান্ত ধর বলে উঠলেন, “স্যার আমি তো কিছু জানি না! আমি যা বলার আগেই বলেছি, তার বেশি কিছুই জানিনা!”
“বেশ, বিশাল মজুমদার বলুন?”
“স্যার শৈবাল আমার দাদা, আমি ওর কাছে দু’দিন এসেছিলাম, সৌজন্যের খাতিরে দেখা করতে, অফিসে কথা বলেই চলে গেছি স্যার!”
“আপনি মিস কঙ্কনা দেবী, আপনি কিছু বলবেন?”
“স্যার আমি তো যা বলার আগেই বলেছি, আর কিছু তো আমি জানি না!”
“বেশ তাহলে কেউ কিছু যখন জানেন না, আমাকেই সবটা বলতে হবে, আমার কাছে কিন্তু সব প্রমান পত্র রয়েছে, তাই কেউ অস্বীকার করলেও ছাড় পাবেন না! মিস কঙ্কনা দেবী একটি পারফিউমের শিশি, শৈবালকে গিপ্ট করেছিলেন মনে পড়ে?”
“হ্যাঁ স্যার আমি দিয়েছি, একটি বিদেশি পারফিউম, আমার খুব পছন্দ তাই স্যারকে দিয়েছিলাম!”
“জানেন কি সেটাই আসলে বিষাক্ত?”
“না, স্যার আমি কিছু জানিনা”
“তাহলে কে জানে বলুন? সত্যি কথা বলুন?”
“আসলে বিশাল মজুমদার আমাকে পারফিউমটা দিয়েছিল, বলেছিলো শৈবালকে এটা দিতে হবে!”
“আপনি বিশালকে কতদিন থেকে চেনেন?”
“চিনি না স্যার, আমাকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে এই কাজটি করিয়ে নেয়!”
“বিশাল বাবু কিছু বলবেন?”
বিশাল বাবু বুঝে গেছেন তিনি ফেঁসে গেছেন জালে, তাই সব স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া পথ নেই।
“স্যার শৈবালের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী, আমার বাবাকে সম্পত্তি থেকে ওর বাবা বঞ্চিত করেন, তাই বদলা নিতে আমি এই পথ বেছে নিয়েছিলাম!”
“সে কি আমি বঞ্চিত করেছিলাম মানে?” অরূপ রতন বাবু চিৎকার করে উঠলেন!
“স্যার অপরাধী যখন অপরাধ স্বীকার করেছে, তখন ওকে কোর্টে চালান করতে হবে! আসলে ওই পারফিউমে ছিল বিষাক্ত বিষ! যেটা ঘ্রাণের সঙ্গে নিলে মানুষ একঘণ্টার মধ্যে মারা যায়! আর সেই পথটাই বেছে নিয়েছিল আঁততায়ী! অতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজটা করেছিল! ধীমান বিশাল মজুমদার ও কঙ্কনা দেবীকে এ্যারেস্ট করো ওদের কোর্টে চালান করতে হবে!
Copyrights@ N.H Biswas
-------------------------------------------------------
নাজির হোসেন বিশ্বাস
কবি-লেখক
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্শজ
---------------------------------------------------------------
Voice Literary Blog
Editor - Bijoy Sarkar
Sub-Editor - Monowar Hossain
..... Chief Organizer.....
Chandan Mahanta
Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice------------------