Sunday, 10 May 2020

একটি রবীন্দ্র জয়ন্তী

"একটি রবীন্দ্র জয়ন্তী" 
    -- মানস চক্রবর্ত্তী 

গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের স্যার বাবাকে বলেছিলেন , 
' পরেশ মেয়েটাকে গান শেখা , গানটা ওর আসে | ' 
বাবা কোনো উত্তর দেয়নি | শুধু 
হ্যাঁ সূচক ভাবে ঘাড়টা নেড়েছিল | 
স্যার দিদিকে কী বুঝিয়েছিল কে জানে ; 
দিদি প্রায়ই বায়না করত 
হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার জন্য 
বাবা হেঁসে বলতেন : কিনে দেবো রে মা | 
তারপর অনেকগুলি পঁচিশে বৈশাখ আর 
বাইশে শ্রাবণ পেরিয়ে গেল 
একদিন দিদি খুব গো ধরল |
কেন , কে জানে, বাবার মেজাজ সেদিন চড়ে গেল 
দিদির গালে সপাটে এক চড় ,
দিদিকে আর কোনোদিন বায়না করতে দেখিনি | 

আমার মা বরিশালের মেয়ে 
দাঙ্গার সময় উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছিল 
কিছুই আনতে পারেনি , কেবল 
একখানা গানের খাতা ছাড়া | 
শুনেছি দাদু নাকি ভালো এসরাজ বাজাতেন 
রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিল 
এ সব অবশ্য মায়ের কাছেই শোনা 
মা যে গান জানতেন সেটা কোনোদিনও 
আমাদের কাছে বলেনি ,
দিদিই প্রথম আবিষ্কার করেছিল  | 
একদিন ঝড়ের রাতে মা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিল 
' যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে ...' 
দিদি চেঁচিয়ে  উঠেছিল , ' মা তুমি গান জান ? ' 
মা দিদির মুখ চেপে ধরেছিল 
তোর বাবাকে বলিস না যেন , 
উনি রাগ করবেন | 
বাবা গান বাজনা খুব একটা পছন্দ করত না | 
গান যে বাবা কেন পছন্দ করত না 
তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমি আজও জানি না 
হয়তো  অভাবের জন্য স্বভাবটা একটু 
রঙচটা হয়েছিল ,
অবশ্য এই নিয়ে মায়ের কোনো অভিযোগ 
ছিল কিনা জানি না ,থাকলেও  
তা প্রকাশ করেনি | 

আমাদের বাড়িতে ঢাউস মার্কা  একটি 
রেড়িও ছিল ,ওটা ঠাকুরদার সম্পত্তি ,
উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা পেয়েছিল | 
কারখানা থেকে ফিরে রাত আটটার  খবর শুনত 
মা দুপুরে শুনত মহিলা মহল , আর টুকুটাকি অনুষ্ঠান ;
সত্যি কথা বলতে কী রেড়িওর ওই ক'টা অনুষ্ঠাই
মায়ের বাঁচার অবলম্বন ছিল |  

আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হতো 
মূল উদ্যোক্তা মা 
বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে 
মা কাপড় রাখার ট্যাঙ্ক থেকে গুরুদেবের ফটোটা বের করে 
একটা জলচৌকির উপর রাখত |
আমি ফুল নিয়ে আসতাম 
দিদি বাটত চন্দন 
মা সুন্দর করে গুরুদেবকে সাজাতেন , মালা পরাতেন | 
একটা আসনে বসে গাইতেন -
'হেঁ নূতন 
দেখা দিক আর-বার 
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ | ' 
আমি আবৃত্তি করতাম | 
দিদি কিছু বলত না , মা বললেও না | 

সেবার পাড়াতে পঁচিশে বৈশাখের প্রস্তুতি চলছে 
অন্য বারের চাইতে জমকটা এবার একটু বেশি 
অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবার নিমন্ত্রিত 
সুলেখা দির কাছে আমি ক'দিন 
বীরপুরুষ আবৃত্তিটা দেখে নিলাম | 
অনুষ্ঠানের দিন দিদি বাড়ির বাইরে বের হল না | 
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরেই 
আমি চেঁচিয়ে শুরু করে দিলাম - 
' সন্ধ্যে হলো , সূর্য নামে পাটে 
এলেম যেন জোড়া দীঘির মাঠে | 
ধু ধু করে যেদিক পানে চাই  , 
কোনোখানে জনমানব নাই | 
তুমি যেন আপন মনে তাই  - ' 
' মা দিদি কোথায় গো ? ' 
উত্তরের অপেক্ষা না করে 
এক দৌড়ে দক্ষিণের বারান্দা ডিঙিয়ে 
বীরপুরুষের মতোই দিদির ঘরে | 
' তুই আজ গেলি না দিদি , 
দারুণ হলো | আমি বীরপুরুষ আবৃত্তি করলাম | 
সুলেখাদি অনেকবার তোর খোঁজ করেছিল | 
তুই কেন গেলি না দিদি ? 
গেলে খুব মজা হতো | 
বনানীদি মায়ের গানটা গাইল  - 
হে নূতন দেখা দিক আর-বার  | ' 
দিদি কোনো কথা বলছে না দেখে বললাম , 
' কিরে আমার উপর রাগ করেছিস ? ' 
' না | তুই এখন যা -
আমার মন ভালো নাই | ' 
আমার আনন্দটা কেমন যেন দমে গেল | 
গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে এসে বসলাম | 
মা রুটি করছিল | 
' জানো মা দিদি আমার সঙ্গে 
ভালো করে কথাই বলল না | ' 
এমন সময় দরজা ঠেলে বাবা ঢুকল | 
হাতে বড়ো মতো কি একটা 
আলোতে আসতেই দেখা গেল - হারমোনিয়াম | 
আমি সুখবরটা দিতে এক দৌড়ে দিদির কাছে 
দেখি ঘরটা প্রায় অন্ধকার 
প্রদীপের আলোটাও নিভু নিভু 
দিদি মেঝেতে শুয়ে আছে | 
' দিদি | দিদি | ' দুবার ডাকলাম 
কোনো উত্তর নাই 
আমি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম - ' মা ' | 
মা দৌড়ে এল 
' কী রে ,  কী হলো ? ' 
' মা দেখো , দিদি কথা বলছে না | ' 
মা গায়ে হাত দিয়ে কি বুঝল কে জানে ! 
আমাকে বলল : হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় | 
মা আসনটা পেতে বসল 
হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে নিয়ে গাইল - 
' আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু , বিরহ দহন লাগে 
তবুও শান্তি , তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে | ' 

Copyrights@ M Chakraborty  

 ---------------------------------------------------------------

       Voice Literary Blog 
       Editor - Bijoy Sarkar 

Sub-Editor - Monowar Hossain 

       ..... Chief Organizer.....
           Chandan Mahanta  

Voice Literary-Cultural Organization
---------------------Voice------------------

1 comment:

  1. খুব সুন্দর মানস দা

    ReplyDelete