Wednesday, 29 July 2020

গল্প : মনি মোহন দে

লেখক পরিচিতি : মনি মোহন দে। ঠিকানা:- দত্তর বাঁধের বিপরীত গলি , লালবাজার , বাঁকুড়া ,পোস্ট + জেলা:- বাঁকুড়া। বয়স :- ৬৫ বৎসর।   শিক্ষাগত যোগ্যতা মেকানিক্যাল
 ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা, পেশা :- অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বাঁকুড়া জেলা জর্জ আদালত।  
 
 মল্লভূম বিষ্ণুপুরের ছেলে , মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা থাকা সত্বেও সময়াভাবে সঙ্গীত জীবনে ভাটা না পড়ার কারণে বাঁকুড়া জেলা জজ আদালতের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হন । চাকুরী সূত্রে  বর্তমানে বাঁকুড়ার বাসিন্দা । ছেলে বেলা থেকেই সঙ্গীতে অনুরাগ । দিদির কাছে গানের হাতে খড়ি । পরের সঙ্গীত গুরু বিষ্ণুপুরের মুরুলী নন্দী ও সনাতন দাস , এবং শেষ গুরু প্রখ্যাত সুরকার মৃণাল বন্দোপাধ্যায় এর একান্ত প্রিয় এই শিষ্য সঙ্গীত জগতের অসংখ্য গুণী সঙ্গীত ব্যাক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছেন । ১৯৮০ সাল থেকে আকাশবাণীর কলকাতা "ক" কেন্দ্রের নিয়মিত আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করে এসেছেন । 

দূরদর্শনের একাধিক চ্যানেল এ অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত,  ইশ্বর বিশ্বাসী , অল্পে সন্তুষ্ট এই মানুষটি বলেন মা সরস্বতীর আশীর্বাদে এখন ও একটু গাইতে পারছি তাই নিজের মনের খিদে মেটানোর তাগিদে গীত রচনা , সুরারোপ , আর কিছু লেখা লেখি নিয়ে আনন্দেই দিন কাটাচ্ছি । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন এইভাবেই কাটিয়ে দিতে পারি এই আমার প্রার্থনা।।  


------------------------------------------------------------------

বৃদ্ধাশ্রম ভালো না খারাপ


     বর্তমান প্রজন্ম মনে করে নিউক্লীয় পরিবারই হ 'লো আদর্শ পরিবার । তারা জানেনা দাদু ঠাকুরমা , জেঠু জেঠিমা , কাকু কাকিমা , পিসেমশাই পিসিমা , মেসোমশাই মাসিমায়েদের মর্ম । তাঁরাও যে বাবা মায়েরই অনুরূপ সেটা তাদের কোনরকমে বোধগম্য করানো যাবে না । অবশ্য তার জন্য আমরাই অনেকাংশে দায়ী । কারন এক পরিবারে ২-৩ জন  ভাই থাকলে , তাদের উপার্জনের তারতম্য থাকার কারণে যেখানে মা বাবা ই  হ'  ইয়ে  যান ভাগের বাবা মা , সেখানে কাকু কাকিমা, মাসিমা পিসিমায়েদের মূল্য কতখানি হ 'তে পারে ? শিশুমনে আমরাই তো বিষ ঢালছি , তাই না ?
  চাকুরীর দোহাই দিয়ে কোনো কোনো ছেলে , বৌমাকে নিয়ে চলে গেল বিদেশে । আর যেসব খোকারা রইলো দেশে , পুরানো পৈত্রিক ভিতেতে তাদের মন টিকলো না , উঠে গেলো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে । বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবা মাকেও নিয়ে এলো সেখানে । আর যে বাবা মা বুঝলেন না , ছেলে বৌমার সাথে মনোমালিন্য তার পর , মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন পৈত্রিক ভিতেতে । কর্মরত অবস্থায় আর্থিক কারণে , বাবা মায়ের প্রতি  সন্তানরা যে ভালোবাসা দিয়ে থাকে , অবসর গ্রহণের পর থেকেই তাঁরা যেন ধীরে ধীরে তাদের কাছে হ 'তে থাকেন অপাংক্তেয় । কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেলে , বৌমা উভয়েই অফিসার হওয়ায় পৈত্রিক ভিতেতেই হোক বা ফ্ল্যাটেই হোক অধিকাংশ বাবা মা- ই অবসর গ্রহণের পর ওল্ড সার্ভেন্ট এবং মেইড সার্ভেন্ট এর পোস্ট এ বহাল হন । বাবা মা দুজনেই জীবিত থাকলে এই অবস্থাতেও একে অপরকে মিথ্যে সান্তনা দিয়ে নিজেদের হৃদয়ের ব্যাথা কিছুটা হ 'লেও  হাল্কা করার চেষ্টা করে কিন্তু যদি কেও একা হন তাহলে তাঁর অব্যক্ত যন্ত্রণা , ভুক্তভোগী ছাড়া কেও বুঝবে না । তবুও আমি মনে ক 'রি  বৃদ্ধাশ্রমে থাকার চেয়ে এটা অনেক ভালো । কারণ জীবনের শেষ কটা দিন ছেলে , বৌমা , নাতি নাতনীদের কাছে থেকে দেখতে তো পাচ্ছেন , তাতেই অনেক টা শান্তি , করুক না যতই অবহেলা , তুচ্ছ , তাচ্ছিল্য । 

    আজকের বৃদ্ধাশ্রম তো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয় , ব্যাবসা ক্ষেত্র । সহায় সম্বল হীন মানুষের ঠাঁয় সেখানে হয় না । ভিক্ষা পাত্র হাতে তাঁদের ঠাঁয় হয় ফুটপাতে । দূরদর্শনে বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম বাসীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে , তাঁদের সাক্ষাৎকারে উপলব্ধি করেছি তাঁদের জীবন যন্ত্রণা ,দেখেছি তাঁদের অসহায় করুন দৃষ্টি । নানাভাবে জানতে চাইলেও সন্তানের নিন্দা না ক 'রে , তাঁদের মঙ্গল কামনা ক 'রে  এটাই বোঝাতে চান যেন তাঁরা সেচ্ছায় এখানে থাকতে এসেছেন । " কু- পুত্র যদিও হয় , কু - মাতা কখনো নয় " । দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে পাতানো নাতির কাছ থেকে কোনো উপহার পাওয়ার পর তাঁদের আনন্দাশ্রু কি বুঝিয়ে দেয় না যে তাদের হৃদয়ের মায়া , মমতা , ভালোবাসায় এখন ও ভাটা পড়ে নি । এই ঘটনা বাহ্যিক না হ 'য়ে যদি আন্তরিক হয় , তাহলে এইরকম নাতি শতকরা ২০ জন থাকলেও অন্তত ২০ জন দাদু ঠাকুরমা ও তো অন্তিম কালে সংসারা শ্রমে থেকেই শান্তিতে শেষ নি:সাশ টুকু ফেলতে পারবেন ।
    নিজের ঘরবাড়ী যতটুকুই থাকুক , আগে তো দাদু ঠাকুরমা' র , তারপর বাবা মায়ের , তারপর আমার । জন্মের পর থেকেই যেখানে হামাগুড়ি দিয়েছি , খেলাধুলা করে 'ছি , দুষ্টুমি করে 'ছি , বাড়ীর একেকটি ইন্টকে ভালোবেসেছি , আমার মনে ক 'রে , এক চিলতে হ 'লেও যে ঘরটিতে জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়েছি , ঘরের কোনখানে আমার জামাকাপড় , জুতো , ছাতা , চশমা , লেখাপড়ার জন্য বই , খাতা , কলম ইত্যাদি রাখা আছে প্রয়োজনে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালে ও সেইসব অনায়াসেই পাওয়া যায় । বৃদ্ধাশ্রমে কি সেটা সম্ভব ? সুখ দু:খের স্মৃতি ভরা সেই এক চিলতে স্বর্গ থেকে বৃদ্ধাশ্রম কি নির্বাসনের নামান্তর নয় ?
    
   একদিন আমরা সবাই বৃদ্ধ হবো । আমরা জানিনা আমাদের শেষ পরিণতি কী ? পাপ পূণ্য ব 'লে যদি কিছু থেকে থাকে , তবে সমর্থ থাকা অবধি যদি আমাদের সাথে থাকা অসমর্থ বয়োজ্যেষ্ঠদের বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে না পাঠিয়ে , সাধ্যমতো সেবাযত্ন দিয়ে যদি তাঁদের অন্তর আত্মাকে বিন্দুমাত্র ও শান্তি দিতে পারি তাহলে আমার মনে হয় সুখ - দুঃখ , শান্তি  অশান্তি , অভাব অভিযোগ , লাঞ্ছনা গঞ্জনা মিশ্রিত গৃহাশ্রম থেকেই উত্তরসূরী দের কাঁধে চেপে হরিবোল ধ্বনি সহকারে হয় তো অমৃত লোকে যাত্রা করার পূণ্য ফল পেলেও পেতে পারি ।


------------------------------------------------------------

স্বাধীনতা কারে কয় 


জন্ম আমার পাঁচের দশকে । স্বাধীনতা কি  তা বোঝার মতো ক্ষমতা তখনো অর্জন করিনি । তবে ছয় এর দশকে ছেলেবেলার দেখা একটি নাটকের একটি সংলাপ " স্বাধীনতা মানে কি জানিস ? স্বাধীনতা হলো ডাল ভাত" আজও ভুলতে পারিনি । সেই সংলাপের অর্থ হইতো  তখন বুঝিনি কিন্তু সেই সময়  স্বাধীনতা বলতে বুঝেছিলাম নিজের ইচ্ছেই কোন কিছু কাজ করার অধিকার পাওয়া । নির্বিঘ্নে এখানে ওখানে যাওয়া । অবশ্যই তখন নিজের পরিবারের মানুষজন  ছাড়াও পাড়া , প্রতিবেশী কাকা , জেঠু , দাদু , ঠাকুরমা , দাদা ,ভাই , বোন সব যেন একই পরিবারের মনে হতো । একের আপদে বিপদে অন্যজন সবসময় পাশে দাঁড়াতো। 
  এলো সাতের দশক । জরুরী অবস্থা ঘোষণা , চারিদিকে বিশৃঙ্খলা , অরাজকতা , নক/নকসালরাজ । যুবসম্প্রদায়ের   পালিয়ে বাঁচার লড়াই।  
এভাবে বলতে গেলে হয়তো একটা উপন্যাস হ'য়ে যাবে  তাই মাঝখানের কয়েক দশকের  অনেকের মনের মণিকোঠায় বাঁধিয়ে রাখা  ছোট বড়ো স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে র সাথে মিশিয়ে দিলাম । 
 আজকের জুবসম্প্রদায়ের  কাছে স্বাধীনতা হ'লো দোকানে দোকানে সাজিয়ে রাখা ছোট বড়ো তিরঙ্গা পতাকার পসরা থেকে একটি সংগ্রহ ক'রে বাড়ির ছাদে এবং নিজের চার চাকা বা দু চাকা থাকলে তার সামনে নিদেন পক্ষে সাইকেলের সামনে সেন্টেও লোকদেখানো দেশপ্রেম জাহির করা । আর বিশাল বিশাল সাউন্ড বক্স লাগিয়ে আমাদের অতি 
সম্মানীয়  দেশাত্মবোধক গানগুলির উপর তাণ্ডব নৃত্য প্রদর্শন করা । 
 আজ কারও মুখে যখন "বন্দে মাতরম " ধ্বনি শুনি তখন নিজেই লজ্জিত হ'ই , মনে হয় তাদের মুখ চেপে দিয়ে বলি অনেক স্লোগান তো  তোমরা আবিষ্কার ক 'রেছো , ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে দেশ মাতাকে শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য বহু  পুন্যাত্মার আত্ম বলিদানের উদ্দেশ্যে নি:স্মৃত , মহামন্ত্র , ব্রিটিশ সরকারের ত্রাস " বন্দে মাতরম " শব্দটি তোমরা কলুষিত   কোরোনা  , তোমাদের মুখে এই মন্ত্র মানায় না । 

 আজ আমরা স্বাধীন । বুঝতে পারছি কি স্বাধীনতা কাকে বলে ? এই অরাজক পুরীতে একটিবারের জন্যও কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে আমরা স্বাধীন ? আমাদের মধ্যে যাদের স্থায়ী একটা কোনো কাজকর্ম নেই তারা কি দু বেলা  দু মুঠো ডাল ভাত পায় ? যে কোন এলাকাতেই হোক আজ কি আমরা স্বাধীন ভাবে , শান্তিতে , নির্ভয়ে  বসবাস করতে পারছি ? সত্যি কি আজ আমরা বাক স্বাধীনতা পেয়েছি ? বাড়ীর বাইরে পা রাখার পর আমরা কি জোর দিয়ে বলতে পারি কাজের শেষে আজ বাড়ী ফিরে আসবো ই ? 
 কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে ভ্রমনোদ্দেশ্যে অথবা জীবিকার তাগিদে দেশের বাইরে পা রাখলে আমরা বলতে পারবো না আমাদের প্রত্যাবর্তন কফিন বন্দী আকারে হবে কি না ? আমাদের মা , বোনেরা সংসারের জন্য যে কোন ভাবে শ্রম দিয়ে প্রাণপাত করেও কি বলতে পারেন তারা স্বাধীন ?

 ইতিহাস স্মরণ করলে লুই বনার্ড , জেনারেল ডায়ার , ক্লিনটন  ইত্যাদি মহান ব্যক্তি গণ যাঁরা পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ত্রাস ছিলেন বলে আমরা জানি , স্বাধীন উত্তর  ভারতবর্ষে আজও তেমনই এমন কয়েকজন কর্নধার আছেন যাঁরা সেই ত্রাস কেও হার মানায় । 
 আমাদের মধ্যে অনেকেই কম বেশী শিক্ষিত । আজ যাঁরা প্রায় বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে ছি , তাঁরা সরকারী , বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনো কর্ম ক 'রে সংসার প্রতিপালন করে এসেছি । কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত হয়েও আজ একটা কর্ম সংস্থানের জন্য দিশাহারা হয়ে বিপথে চালিত হতে বাধ্য হচ্ছে । তারা জানেনা তাদের গন্তব্যস্থল কোথায় ? কি আছে শেষে ? এই হলো বর্তমান স্বাধীনতার রূপ । 
  স্বপ্নে দেখি আমরা সকলে মিলে কি আর একবার গর্জে উঠে সমবেত কণ্ঠে মনে প্রাণে উচ্চারণ করতে পারি না __
ভারত মায়ের পূণ্য ভূমি মুক্ত হয়ে ছে রক্তে যাঁদের 
   স্বাধীন প্রাতে শপথ করি 
 অবহেলা যেন না করি তাঁদের।  

------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment