Wednesday, 29 July 2020

গল্প : চন্দন চক্রবর্তী

গল্প
----

লেখক পরিচিতি :
আমি চন্দন চক্রবর্তী একজন অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মচারী । আমি একজন সংগীত শিক্ষক । আমার সুর করা গানের ইউটিউব চ্যানেলে Gaan o Golpo chandan chakraborty। এখানে আমার ছাত্র ছাত্রীদের গাওয়া গান আছে । আমার গলা পড়ে গেছে । 

বর্তমানে গলা পড়ে যাওয়ায় ফেসবুক করি । একটু আধটু লিখি। আমার নিবাস : রোড নাম্বার 2, 
গ্রাম : প্রীতিনগর , পোস্ট : প্রীতিনগর, থানা : রানাঘাট, জেলা : নদীয়া।

----------------------------------------------------------------

দাও সততা ফিরিয়ে
      

              বাড়ি এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই প্রমাদ গুনলাম ! ব্যাংক থেকে ভারী এমাউন্টের একটা বান্ডিল তুলে বা পকেটে রেখেছিলাম । সাথে স্মার্ট ফোনটাও ছিল । এবার ফোনটা বের করে আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে পরখ করলাম । না নেই ! টাকাটা গেল কোথায় ? বাড়িতে কিছু বলতেও পারছি না । ভাবছি কোথায় পড়তে পারে ? 

 পকেটে ঢোকানোর সময় মেঝেতে পড়েনি তো ! না,তা হবে না । তখন বেশ সাবধানে ফোনটা বের করে টাকাটা ঢুকিয়েছি । কাজেই মন সায় দিল না । এবার মনে পড়ল মাংসের দোকানে মোবাইলটা বের করেছিলাম । তখন বান্ডিলটা ফোন টানার সময় পরতে পারে । হ্যা তাই হওয়া সম্ভব ।

     মুরগীর দোকানে বেঞ্চে দুজন গরিব শ্রেণীর মহিলা বসেছিল । কি মনে হল মোবাইলটা বের করে ওদের অনুমতি নিয়ে একটা ছবি নিয়েলাম । মন বলছে একমাত্র তখনই এটা পরা সম্ভব । না তারপরে আর ফোন বের করিনি । আবার ছুটলাম বাজারে । সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে ! 


দোকানে পৌঁছলাম । মহিলা দুটো নেই । বেলা অনেকটা গড়িয়েছে । দোকানে খরিদ্দার নেই । দোকানি গোছগাছ করছে । এতটা সময় পার হয়েছে !  তবুও মন মানে না । মেঝেতে তাকালাম । না নেই । এবার আমাকে দেখে দোকানী যা বলল তা শুনে বুকে একটু বল পেলাম । 

গঙ্গাপারে ইট ভাটায় মালতির মা বস্তিতে থাকে । মুরগির দোকান থেকে নাড়িভুঁড়ি কিনে নিয়ে যায় । আজও নিতে এসেছিল । ও বলে গেছে ওদের বস্তিতে দেখা করতে । 


সাইকেলে যেতে দশ মিনিট । পৌঁছে গেলাম ওদের বস্তিতে । খোঁজ করে পেয়েও গেলাম । টালির চালা । ইট মাটির গাঁথনীর ঘর । চালাটা নিচু । মাথা নাবিয়ে ঘরে ঢুকতে হয় । ওদের পান্ডা গোছের কেউ আমাকে ওদের এলাকায় ঢুকতে দেখে আমার সাথেই আসছিল । ঘরের সামনে এসে ডাক দিতেই মালতির মা বেরিয়ে এলো । হাতে টাকার বান্ডিল । কি করে যেন আগেই জেনে গেছে আমি খোঁজে এসেছি । আমাকে টাকাটা দিয়ে লোকটার সাথে দুর্বোধ্য ভাষায় কি বলে আবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো ।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কেমন  বোবা হয়ে ছিলাম । এইবার একটু সহজ হয়ে পান্ডা লোকটার দিকে তাকাতেই ও আমাকে একটা চায়ের দোকানে এনে বসাল । 


দোকানীকে চায়ের কথা বলে লোকটা আমাকে ঘটনাটা যা ঘটেছে একটু বিশদে জানাল । টাকাটা যখন পায় তখন দোকানে কেউ ছিল না । দোকানিও কিছু দেখেনি । টাকা খুব খারাপ জিনিস,লোভ লালসা বাড়ে । তাই ও দোকানিকেও জানায় নি । শুধু বলে এসেছে বাবু যেন ওর সাথে দেখা করে । কথাটা ও পান্ডাকে এসেই জানিয়েছে । আরো কিছু কথা হল ।  জানতে পারলাম ওর বর ক্যানসারের পেশেন্ট । বিছানায় শেষ শয্যায় । আগে দুজনেই ইটভাটায় কাজ করতো । এখন বয়স হয়েছে । ভারী কাজ করতে পারে না । ও সকালে কাছের বাজারে অনেকগুলো দোকানে সকালে গিয়ে ঝার দেয় । তাতেই সংসার চলে । ফেরার পথে মাঝে মাঝে মুরগির ছাল,নাড়িভুঁড়ি সওদা করে ফেরে । 


পান্ডা লোকটার ভাষা একটু অন্যরকম হলেও বাংলাটা বোঝে । একটু একটু বলতে পারে । এতক্ষন শ্রোতা হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। এবার প্রতিদানের কথাটা মাথায় এলো । পাঁচ হাজার টাকা গুনে পান্ডার হাতে দিতে গেলাম । নিতে অস্বীকার করল । আমি কেমন বোকা বনে গেলাম । চায়ের পায়সাটাও ওই লোকটাই দিয়ে দিল । এটা বুঝি আতিথেয়তা ! 


না চোখ দিয়ে জল ঝরে নি । বুকের ভেতরটা কেমন দপ দপ করছে । তার কারণও আছে । এটা হচ্ছে কারণ জীবনের মূল্যবোধগুলো যা ভারতবর্ষকে  বিশ্ব সেরা হিসাবে চিহ্নিত করেছিল তা আজও বিদ্যমান !  হাতটা নিজেই কপালে উঠে একটা প্রনাম সারলো !


 পথে ছোট্ট একটা মন্দির । ঠাকুরটাকে চিনতে পারলাম না । মূর্তিটা সিঁদুরে লালে লাল । এখানে দুহাত তুলে প্রনাম করলাম । প্রনাম করলাম ওপর তলার জন্য । দেশের যারা ওপর তলার,তাদের জন্য দোয়া চেয়ে নিলাম !!!


-------------------------------------------------------------------

একটা কাগজ
      

সেই কত কাল আগের বাক্সটা আজকে নাড়া খেল ! সেই যে কালে বাড়িতে গাধা গরু কথায় কথায় শুনতে হত,বাক্সটা তখন থেকে আমার সম্পত্তি । ওটায় আমার সব কিছু রাখা থাকতো । এমন কি ওটা আমার ব্যাংকও ছিল । 


আজ অনেকদিন পর বাড়ি রং হল । কাজ শেষ হতে যেখানের'টা সেখানে রাখা শুরু । স্ত্রীর সাথে আমিও হাত লাগিয়েছি । স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল বাক্সটাকে দূর করে ।


মন থেকে পারলাম না । সময় সুযোগ বুঝে খুলে বসলাম । কেমন যেন একটা ব্যাথা বোধ হল ।


ডালা খুলে বেরিয়ে পড়ল আমার ফেলে আসা জীবনের অনেক কিছু । যেগুলো আমাকে আনন্দ দিতে এক সময় সচেষ্ট ছিল । 


ওই তো লাট্টুটা ! এক সময় কত খেলেছি । মারামারি হয়ে গেছে সাথীর সঙ্গে । ঐতো গাড়িটা ! ওর একটা চাকা হারিয়ে কাত হয়ে চলতো । টুকিটাকি নাড়ছি আর আমার স্মৃতি জানালা খুলে খুলে যাচ্ছে । 

একটা টিনের পেন্সিল বাক্সকে আমার ব্যাঙ্ক বানিয়েছিলাম। ওটা খুলতে কতগুলো পয়সা বেরিয়ে এলো যা আজকাল অচল । পেলাম কতগুলো বাৎসরিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র । আর সব শেষে পেলাম একটা ভাজ করা কাগজ ।


রেখেই দিচ্ছিলাম । কি মনে হল কাগজটা খুলে ধরতেই একটা ধাক্কা খেলাম ! কে লিখেছে কাকে লিখেছে কোন কিছুর উল্লেখ নেই ! কেবল তিনটে শব্দ লিখে কেউ তার মনের ভাব প্রকাশ করেছে !


আমাদের সময় কাঁচা বয়সে শব্দগুলোর মর্মার্থ না জানলেও প্রয়োগটা আমরা কিভাবে যেন জেনে যেতাম । এই লেখাটাও তেমনি কারো কাঁচা হাতের নিতান্ত ছেলে মানুষি । 


কাগজটাতে ভেসে উঠলো লাজুক চোখের চাহনিতে কোন মুখ,যার এক মাথা কালো চুলে দুদিকে দুটো বিনুনি,কপালে ছোট্ট একটা টিপ ।   


মনে পড়ে গেল,সরস্বতী পুজোর স্কুলের জলসায় তাকে প্রথম দেখি । তারপর অনেক সাধ্য সাধনায় তার কাছ থেকে একটা কাগজ পেয়েছিলাম । তাও তার চেনা কোন সিনিয়ার দিদির হাত দিয়ে । আমার তরফ থেকে পকেটে কাগজ নিয়ে ঘুরলেও সম্ভব হয় নি সেটাকে আগে বাড়িয়ে দিতে । কাগজটা পাওয়ার পর অনেকগুলো রাত ঘুমতে পারিনি । 

না তারপর ব্যাপারটা আর এগোয় নি। 

বাক্সের ভিতরের সব জিনিসের দামই আজ আর নেই ।  পয়সাগুলোও অচল । সব ফেলে দিলেও কিছু যায় আসে না ।  


কিন্তু কাগজের টুকরোটা যে এখনও সচল তার প্রমান পেলাম চোখে হাত দিয়ে !।

------------------------------------------------------------------

হৃদয় চুরি
  

সন্ধ্যাবেলা সবে চায়ে চুমুক দিয়েছি,একটা শোরগোল কানে এলো ! মনে ভাবি ; এই ভর সন্ধ্যায় চোর চোর করছে কারা ! 

শোরগোলটা এগিয়ে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি রাস্তায় এলাম । কেউ একজন প্রাণ ভয়ে দৌড়ে আসছে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে ফেললাম । 


লোকটা থর থর করে কাঁপছে দেখে, তাড়াতাড়ি রাস্তায় বসিয়ে দিলাম । পেছনে যারা তাড়া করে আসছিল তাদের জোরে ধমক দিয়ে আটকে দিলাম । নইলে এসেইতো ঘা মেরে হাতের সুখ করবে,সত্য মিথ্যা যাচাই করার আগেই !


এতক্ষনে লোকটার দিকে নজরটা ভালো করে বুলিয়ে সবাই এক প্রকার নিশ্চিত হলাম লোকটা আর যাই হোক চোর নয় । বেশ বুড়ো । জামা কাপড় বেশ ভদ্র গোছের । লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে এক গ্লাস জল চাইলো । 


এবার কিছু প্রশ্ন ওকে করতে যাব,দেখি লোকটা কাঁদছে ! কাঁন্নাটাও মনে হয় সত্যিকারের । যেন বুকের পাঁজর ঠেলে বেরিয়ে আসছে ! বুড়ো বলতে আরম্ভ করলো । 


ভদ্রলোক কাছেই থাকেন । ছেলে,বৌমা আর ছোট্ট নাতি নিয়ে তার সংসার । স্ত্রী মারা গেছেন । কিন্তু সে অভাব তিনি সামলে ছিলেন নাতিটাকে পেয়ে । সারাদিন ওর সাথে খেলে তার সময় কেটে যেত । ওর মুখের আধো বল শুনে রোগ ব্যাধি ভুলে তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন । কিন্তু হঠাৎ কি হল ! 


আগেই ছেলে বউয়ের সাথে মাঝে মাঝে অশান্তি হচ্ছিল । সেটাই পরে বিরাট আকার ধারণ করল । ওরা আলাদা হয়ে এদিকে কোথায় বাড়ি নিয়ে চলে এলো ! ঠিকানাও দেয় নি । বছর খানেক হল আর কোন যোগাযোগ নেই ।


এতদিন রাগ করে কাটিয়েছেন । কিন্তু কদিন ধরে তার মনটা আনচান করছিল । নিজেকে আর সামলাতে পারছিলেন না । লোকের মুখে শুনেছেন ছেলে এখানে কোথায় ঘর ভাড়া করে আছে । আজ বিকেলে তাই বেড়িয়েছেন নাতিকে একবার দেখার জন্য । 


ঘুরতে ঘুরতে একটা জানলার দিকে চোখটা আটকে গেল । ঘরে আলো জ্বলছে ।  বাচ্চাটাকে দেখতে পেলেন । একদম একই বয়সী । খুব মিষ্টি বাচ্চাটা এক একা খেলছে । তিনি এগিয়ে গিয়ে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন । 


বাচ্চাটা হঠাৎ ওকে দেখতে পেয়ে চোর মনে করে বাবাকে ডাকতে আরম্ভ করায় তিনি নিজেই ভয় পেলেন । অপরিচিত জায়গা ।  দৌড়ে সরে যেতে চাইলেন । কিন্তু পালাতে গিয়ে হল এই বিপত্তি ! 


তার কপালটা খারাপ । না হলে এমন হয় ! তার হৃদয় চুরি করে যে পালিয়ে গেল তার শাস্তি না হয়ে তাকে শাস্তি পেতে হল,চোর অপবাদ নিতে হল,সামান্য জানালায় উঁকি দেবার অপরাধে ! এতগুলো কথা বলে মানুষটা জোরে শ্বাস ছাড়লেন ।


উপস্থিত সবার দিকে এবার ঘুরে তাকিয়ে  অবাক হলাম । আগে যারা মানুষটাকে চোর ভেবে মারতে এসেছিল তারাই এখন শ্রোতা হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে । অনেকেরই চোখে জল  ! 

আরো দেখার বাকি ছিল । এবার একটা বাচ্চাকে হাতে ধরে জনৈক কেউ এগিয়ে এলেন । আমরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছি । এগিয়ে এসে তিনি বুড়োকে হাতে ধরে যত্ন করে তুলে দাঁড় করালেন ।সবার কাছে অনুমতি চেয়ে বুড়ো মানুষটাকে তার বাড়িতে নিতে চাইলেন ।

বুড়ো মানুষটা এখন ধীর কদমে নতুন নাতির হাত ধরে এগিয়ে চললেন। সেদিকে তাকিয়ে আমার চোখেও এখন জল।


---------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment