প্রাবন্ধিক পরিচিতি : অনিতা রায় মুখার্জী একজন গৃহবধূ। তার ছেলে দীপ্তাংশু রায় মুখার্জী একজন প্রতিভাবান তরুন কবি, সেই সুবাদে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন এবং লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেন। সেই থেকেই সাহিত্য জগতের সাথে তিনি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
বর্তমানে তিনি প্রাঙ্গণ সাহিত্য পত্রিকার প্রচার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাছাড়া আরও কটি পত্রিকার সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন।
--------------------------------------------------------
প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ
সব দেশে সব যুগেই মহৎ প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। তাদের প্রতিভার আলোয় আলোকিত হয় দেশ ও জাতির প্রাণ। বাঙালি তথা ভারতবাসীকে যাঁরা সম্মানের আসনে তুলে ধরেছেন তাঁদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। কবি হিসাবে বিখ্যাত হলেও গল্প , উপন্যাস , নাটক, নৃত্যনাট্যর পাশাপাশি তাঁর রচিত গানগুলি বাঙালির হৃদয়ে আজও গেঁথে আছে । তাই সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার তখন ছিল শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান। আধুনিকতার প্রাণকেন্দ্র , জাতীয়তাবাদের উন্মেষক্ষেত্র।এইরকমই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সেদিন মঙ্গলশঙ্খে ধ্বনিত হয়েছিল সেই শুভ বার্তা ---শিশুপুত্র রবীর জন্মকে ঘিরে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মক্ষণের মঙ্গলশঙ্খধ্বনি বোধহয় ভারতবর্ষকে ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে ধ্বনিত হয়েছিল যদিও তা অশ্রুতপূর্ব ছিল। ঠাকুর পরিবারেই উন্নত পরিবেশে গৃহশিক্ষকের নিকট তাঁর বিদ্যাচর্চা শুরু। ছয় বছর বয়সে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন।কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকে তাঁর পড়াশুনায় মন বসত না তাই গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে বাড়িতে বসে লেখাপড়া করেন এবং নানা বিষয়ে শিক্ষালাভ করে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি বিলেতেও যান। প্রথমে পাবলিক স্কুল ও পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়। দেড় বছর পর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।দেশবাসীকে যথার্থ পরিবেশে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বোলপুরের কাছে প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তিনিকেতন। সেখানে মুক্ত পরিবেশে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গড়ে তুললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রীনিকেতন। দেশ বিদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী সেখানে শিক্ষালাভ করতে আসত।তার সাথে তিনি জমিদারীর কাজও দেখাশুনা করতেন।
সাহিত্য সাধনাই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।ঠাকুর পরিবারের সৃজনশীল পরিমন্ডলেই তাঁর কাব্যচর্চা শুরু।ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য রচনা করতে ভালোবাসতেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁর রচিত প্রথম কাব্য" অভিলাষ "। এরপর একের পর এক সৃষ্টির প্রাচুর্যে ভরে উঠল তাঁর সাহিত্যের সোনারতরী। তাঁর ছোটগল্পগুলি আজও অসাধারণ। কাবুলিওয়ালা, পোস্টমাস্টার , গুপ্তধন, চোখেরবালি, দেনাপাওনা ইত্যাদি গল্পগুলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্প হিসাবে বিবেচিত হয়। নৌকাডুবি, রাজর্ষি উপন্যাসের তুলনা হয় না। বিসর্জন, রাজা ও রানী, অচলায়তন, ডাকঘর, রক্তকরবী ইত্যাদি নাটকের সাথে শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা প্রভৃতি নৃত্যনাট্যের রচয়িতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে আজও প্রিয়।তার সাথে এসে মিশল সঙ্গীতের ধারা। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ " আত্মশক্তিতে জেগে ওঠা " তখন মন্ত্রের মত কাজ করেছিল। সেই সময়েই তাঁর লেখা বিখ্যাত গান -------------
" বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক পূণ্য হউক
হে ভগবান "।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে মন্ত্রপূত বানীর মত কাজ করেছিল। সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতিকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য তিনি রাখীবন্ধন উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন।পবিত্র গঙ্গার জলে স্নান করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে পরষ্পর পরষ্পরের হাতে যে সম্প্রীতির বানী ছড়িয়েছিল তা বলা যেতে পারে ইংরেজ সরকারের ভিত্তিকে টলিয়ে দিয়েছিল।তার ফলশ্রুতি হিসাবে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯১১ সালে বঙ্গঙঙ্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তাঁর দুটি উপন্যাস "গোরা" ও "ঘরেবাইরেতে" স্বদেশী চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।গোরা উপন্যাস জাতীয়তাবাদকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছে যায়। তিনি সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও গান্ধীজির অসহযোগ , অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একই মতাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। একথা অনস্বীকার্য গান্ধীজিকে "মহাত্মা " উপাধি তো রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া।
"তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে
কেমন করে সইব
বাতাস আলো গেল মরে
এ কি রে দুদৈর্ব "।
সাল ১৯১৯ বৈশাখী উৎসবের দিন অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে তখন হাজার হাজার নরনারী সমবেত রাওলাট আইনের প্রতিবাদের জন্য। কিন্তু জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে গুলিবর্ষনে মৃত্যু হয় প্রায় ৩৭৯ জনের যদিও হিসাবটা বেসরকারি। এই নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এক হয়ে সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন। মর্মাহত কবি রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির জন্য ইংরেজ সরকারের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। এর দ্বারাই বোঝা যায় তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশানুরাগ কত গভীর ছিল। তিনি একাধারে ছিলেন একজন বড় দার্শনিক , চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ ও একজন আচার্য। তিনি ভাষাসাধক, কবিশ্রেষ্ঠ তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব ও অহংকার ........
"জগৎ কবির সভায় মোরা
আজিকে করি গর্ব
বাঙালি আজি গানের রাজা
বাঙালি নহে খর্ব। "
অবশেষে কবির জীবনে এল অস্তমিত হওয়ার মুহূর্ত। ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবন তিনি পরলোকগমন করেন। আমাদের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কেবল নয় পৃথিবীর ইতিহাসে যে কবির নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি চলে গেলেও আমাদের পূর্ণ করে রেখে গেছেন। তিনি হলেন সর্বকালের সর্বযুগের সেরা মনীষী। তাঁর জন্মদিনটিকে আজও আমরা শ্রদ্ধার সাথে পালন করে থাকি। তিনি আছেন, থাকবেন আমাদের মনের মনিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে। তাই কবিগুরুর ভাষায় ................
"তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম "।
---------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment