গল্প
----
লেখক পরিচিতি : সৌরভ চ্যাটার্জী।
Computer science engineer
বর্তমানে FUNCELL GAMES PVT. LTD তে চাকরি করি।
বাড়ি: উত্তরপাড়া (হুগলী )।
--------------------------------------------------------------------
আবার
"রােজই দেখি তােকে বাবু... !
সেই ছােট্ট থেকে, কথনােই তােকে চোখের আড়াল করি না|
সেই যে সেই একদিন তাের ছােট্ট শরীরটা আমার শরীর থেকে আলাদা করে নিয়েছিল, সেবার জ্ঞান হারাবার আগে
একবারই তাের মুখটা দেখতেপেয়েছিলাম, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিলাে, মন টা দুমড়ে গিয়েছিলাে অভিমানে, কষ্টে| আমি যে
ডাক শুনতে পেয়েছিলাম! চলে যাওয়ার ডাক! তােকে, তাের বাবাকে, সবাইকে একেবারে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে শেষ
মুহূর্তে তাের প্রথম কান্না আমার কানে যেন সুরেলা সংগীত এনে দিয়েছিলাে | মনের সব অভিমান শ্রাবণের বর্ষার মতাে
চোখ দিয়ে ঝরে পড়েছিল | তলিয়ে গিয়েছিলাম একরাশ মন কেমন করা অন্ধকারে!
তারপর অনেক দিন কেটেছে | শেষ মুহূর্তের মায়ার বাঁধন কাটাতে পারিনি | আমাদের জগতে মায়া না কাটলে ফিরে ফিরে
আসতে হয় আবার পৃথিবীতে | কিন্তু সে ফিরে আশা সুখের নয় | যত মায়ায় আটকে পড়া, ততই নিকৃষ্ট প্রাণী হিসাবে
পুনর্জন্ম হয় | মাযা না কাটলে মুক্তি লাভ হয় না, পূর্বস্মৃতিও হারায় না| সেটাই অভিশাপ | যাদের নিয়ে মায়া তাদের কাছে
পৌছলেও তারা চিনতে পারেনা | আমিও ফিরে এসেছি | তােরা চিনতে পারিসনি |
সেই যেদিন হামাগুড়ি দিতে দিতে সিঁড়ির দিকে চলে গিয়েছিলি! বাড়িতে সবাই ঘুমােচ্ছিলাে! আমি তাে কখন থেকেই তাের
বাবার কাছে জানাচ্ছিলাম যে তাের বড়াে বিপদ | খুব নিকৃষ্ট জন্ম হয়েছিল আমার! সেবার আমি মশা ছিলাম! তাের
বাবার কানের ভিতর ঢুকে গিয়েছিলাম| কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে বিরক্ত হয়ে উনি আমায় এক চড় মেরেছিলেন | অবশ্য তার
পরেই পাশে তােকে না দেখে খুঁজতে খুঁজতে সিঁড়ির কাছ থেকে তােকে ধরে ফেলেছিলেন |
আমার মাথাটা থেঁতলে গিয়েছিলাে | জ্ঞান হারাতে হারাতেও তােকে খুঁজে পাওয়ার হট্টগােল শুনে খুব শান্তি পেয়েছিলাম |
তারপর সেই যে তুই আধাে আধাে গলায় ডাকলি -- বাব্বা!
তাের বাবা ফোনে কিসব ঝগড়া করছিলেন, চমকে ফিরে তাকিয়েছিলেন! সব খারাপলাগা মুহূর্তে চোখের জলে মিশে
গিয়েছিলাে | দৌড়ে এসে তােকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন! আমিও খুশিতে চিৎকার করে উঠেছিলাম | আমার চোখেও জল
এসেছিল| আমার দিকে তাের বাবা বিরক্তভাবে তাকিয়েছিলেন।| তবে আমার সাদা শরীর আর লিকলিকে ছােট্ট জিভ দেখে
চিনতে পারেননি | টিকটিকি মারার ওষুধ নিয়ে এসে আমার গায়ে ছুড়েছিলেন | আবার অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতেও তাের
গলায় দু বার সেই 'বাব্বা, বাব্বা' শুনে একটা শেষ দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল বােধহয়।
তারপর কতদিন কেটে গেছে| আমি ছায়ার মতাে তাের সঙ্গে থেকেছি | তােকে চোখে চোখে রেখেছি।
তাের প্রথম স্কুলের দিন তাের সঙ্গে স্কুল গেছিলাম | ফেরার সময় ঘােষদের পুকুরপাড়ের কাছে কোলাব্যাঙটা হঠাৎ জিভ
বাড়িযে আমায় চেপে ধরেছিলাে| আমার চিৎকার তুই শুনতে পাসনি | একটা মাছির চিৎকার মানুষ শুনতে পাযও না| ওর
মুখের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যেতে যেতেও তাের চলে যাওয়ার পায়ের আওয়াজই শুনেছি।
রাত জেগে তাের পড়াশােনা দেখে গর্বে বুকটা ফুলে উঠত | আমিও ছােটবেলায় খুব পড়াশােনা করতে ভালােবাসতাম| তবে
তাের কাছে আর যেতাম না| তাের আরশােলায় বড়াে ভয় যে! দূর থেকেই দেখতাম | শেষকালে একদিন তাের বাবা।
অসাবধানে আমায় মাড়িয়ে ফেললেন | তখন তুই কলেজ গিযেছিলি | সেবারে আর তােকে শেষবার দেখা হয়নি |
সেই থেকে আরও অনেক ভাবেই তােকে দেখেছি| কখনাে ফড়িং হযে, কখনাে মৌমাছি হযে, কখনাে বা অন্যকিছু হয়ে |
প্রত্যেকটা জন্মে দুনিয়ার রং টা বদলে বদলে যায় | চোখগুলােও পাল্টে যায় তাে | কিন্তু সব পাল্টালেও তােকে একইরকম
রকম দেখতে পাই বাবু। তােকে দেখলে সব রং মিলে মিশে এক রং হয়ে যায় | সব চোখ একরকম হয়ে যায় | আমার
জীবনটায় তুইই খুঁটি | তােরই চারপাশে কেবল ঘুরি | চলে গিয়েও ফিরে ফিরে আসি শুধু আবার তােকে দেখবাে বলে |
তােকে না দেখতে পেলে যে ওপারেও শান্তি পাই না! মন টা মরুভূমির মতাে খাঁ খাঁ করে ।
শেষবার ছেড়ে আসার পরে কয়েকদিন আর ফিরে আসতে পারিনি | কি জানি কেন আসিনি | অন্যরা আর না জন্মালে খুশি
হয়, আমি যে তােকে না দেখে, তাের কাছে না এসে থাকতে পারি না! অনেক কষ্টে আবার একবার ফিরে এসেছি | তবে
মনে মনে আশঙ্কা হচ্ছে, এই বােধহয় শেষ | আর হয়তাে আসা হবে না |
এবার এসে হঠাৎ শুনলাম যে তাের বিযে! বাড়িতে অনেক অতিথি ছিল তাই আর বেরােতে পারিনি | লুকিয়ে ছিলাম |
আমায় কেউ দেখলে যদি শেষবারের মতােও তােকে না দেখতে পারি! তােকে বিয়ের আগে আশীর্বাদ করতে পারবাে না
ভেবে বুকের ভিতরটা দলা পাকিয়ে উঠেছিল | কিন্তু একদিন তাের বাবা আমার ছবির সামনে দাঁড়িযে খুব কাঁদছিলেন |
ওঁর দুঃখ আমার গায়েও আঁচ ফেলেছিলাে| অজান্তেই চোখে জল এসেছিলাে |
আশীর্বাদ না করার বেদনাটা ভুলে গেছি | তাের বৌকে বরণ করতে পারিনি, তার কষ্টও পাইনা| তােকে দেখতে পাই,
মনুষ্যদেহ ত্যাগ করার এতাে বছর পরেও, ভাই বা কম কি?
এখুন সবাই চলে গেছে | আমিও বেরিয়ে এসেছি | এবারে চোখের দৃষ্টিটা খুব কম | তবুও তােকে দেখতে পাচ্ছি | কিরকম
শান্ত ভাবে তুই ঘুমােচ্ছিস! তাের পাশে তাের বৌ | ভারী মিষ্টি হয়েছে মেযেটা | আমি প্রাণ ভােরে চোখ ভােরে শুধু
তােদেরকে দেখতে চেয়েছি... এর চেয়ে বড়াে চাওয়া আর কোনােদিন কিছু হয়নি| এইটাই আমার প্রথম ও শেষ চাওযা --
জন্ম জন্মান্তরের! হয়তাে শেষবারের মতাে ---"
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলাে দীপিকার | সুমিতের সঙ্গে আজ তার ফুলশয্যা | ঘুমিযেও পড়েছিল গভীরভাবে, কিন্তু কি একটা
অস্বতিতে ঘুমটা ভেঙে গেল | বেডসাইড ল্যাম্প টা জ্বেলে একটু জল খেতে গিযেই ভযে আঁতকে উঠলাে সে | তার বরের
মাথার কাছে টেবিলের উপর শাশুড়ির ছবির ঠিক পাশে একটা প্রমাণ সাইজের তেঁতুলবিছে | সুমিতের মুখের ঠিক সামনেই
কি সব্বোনাশ! কাঁপা কাঁপা হাতে সুমিতকে নাড়ালাে দীপিকা| দু তিন বারের ঠেলায় জেগে উঠল সুমিত | চোখ না খুলেই
ঘুমজড়ানাে গলায় বলে উঠল,
"আঃ কি হলাে? ঠেলছ কেন?"
"বি-বি-বিছে! বিছে!"
"কি? বিছে? কোথায়?
"তােমার মুখের ঠিক সামনে!"
চোখ খুলেই বিছেটাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেলাে সুমিত | মুখের সামনে না বলে মুখের উপর বলাই বােধহয় সমীচীন |
এখুনি হয়তাে কামড়াতে পারে | কাঁপা কাঁপা গলায় দীপিকাকে ডাকলাে সে|
"দেয়াল আলমারিটার উপরের তাকে পােকা মারার স্প্রে আছে | শিগগির নিয়ে এসাে | জলদি --"
পােকা মারা স্প্রেটা ক্ষিপ্র গতিতে নিয়ে এলাে দীপিকা | সুমিত কোনােমতে নাকে হাত চাপা দিতেই সেটা বিছেটার গায়ে
ছড়িয়ে দিলাে সে | বিছেটা কিন্তু একটুও নড়লাে না | খানিকক্ষণ একই জায়গায় একই ভাবে বসে রইলাে | তারপর আস্তে
আস্তে ঢলে পড়লাে টেবিলের পিছনে |
আতঙ্কটা কাটাতে একটু সময় লাগলাে সুমিতের | উঠে গিয়ে মুখে জল দিয়ে এলাে! অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পরে
আবার ঘুমিয়ে পড়লাে | দীপিকা কিন্তু সহজে ঘুমাতে পারলাে না | বিছেটা ওতাে কাছে এসেও কামড়ালাে না কেন? কিছুতেই
বুঝে উঠতে পারছিলাে না সে | শেষে কোনাে একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়লাে |
টেবিলের পিছনের থেকে একজোড়া নিশ্চল চোখ তাদের দিকে চেয়ে রইলাে |
------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment