গল্প
----
তাঁর লেখা নাটক ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘দেবী প্রশস্তি’, ‘পারবতীর সংসার’, ও ‘অশনি সংকেত’, প্রশংসিত হয়েছে দর্শকদের কাছে৷ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নিয়মিত অনুশীলন ও সংরক্ষণের জন্য ২০১০ –এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘কৃষ্টি কলাকেন্দ্র’ ৷ বিদ্যালয় স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের নাট্য চর্চায় উদ্বদ্ধ করতে ‘মহড়া’ স্থাপন করেন৷ ‘ছায়া স্কুল অফ আর্ট (চন্ডীগড়)’, ‘শিল্পী ও শিল্প’, ‘উত্তরের রোববার’, ‘মোহিনী প্রত্রিকা’ সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইতিমধ্যে সংবর্ধিত হয়েছেন৷ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২৭টি অনুগল্প সম্বলিত বই "অনুগল্প কিংবা স্পর্শক"।
------------------------------------------------------------------
ভাঙ্গা-গড়া
এতবড় জোর ধাক্কা খাবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি বোধহয়৷৷ক’দিন ধরে ছেলেটা একেবারে মুষড়ে পড়েছে৷ ঘর থেকে প্রায় বেরই হচ্ছে না৷ কাউকে কিছু বলছেও না৷ মেসের অন্যান্য বন্ধু বা দাদারা জিজ্ঞেস করলে ছোট্ট উত্তর- ‘শরীরটা ভালো না’ ৷
---তা হলে ডাক্তার দেখা৷ আবার কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছে ‘বাড়ী যা’ ৷ পরামর্শ বা উপদেশ দেবার লোকের অভাব নেই৷ অঙ্কিত অবশ্য কারো কথাই গ্রাহ্য করে না৷ ক’দিন ক্লাসেও যায় না, শুয়ে বসে মোবাইলে চোখ রাখা আর মাঝে মাঝে বই খুলে বসা৷ মেসের বন্ধু বিমল খোঁজ খবর নিচ্ছে বন্ধু মহলে
----‘কী ব্যাপার বল্ তো ? অঙ্কিত কী ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে ?’
---- বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর একটু আভাস পেলো পিন্টুর কাছে-‘হ্যাঁ, ডুবে ডুবে জল খেতে গিয়ে জল খাওয়া তো হলই না ধাক্কাটা খেল বেশ জোড়ে৷’
---- তাই ?
--- সেরকমই তো শুনলাম৷ তবে ডিটেইলস আপদেট দিতে পারব না৷
--- একটু ক্লু ?
--- এই সব ব্যাপার স্যাপার নিয়ে বিশালের সাথে নাকি বন্ধুত্ব ক্লোজড্ !
--- বলিস কি রে ?
--- তবে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলে দু’জনেই অ্যাভয়েড করছে৷
--- অতিরিক্ত গলাধরা দোস্তির এই হাল ?
--- আন লিমিটেড কিছুই ভালো নয় ভাই৷ বিজ্ঞের মত কথা বলে পিন্টু মুচকি হেসে চলে গেল৷ মনে মনে বোধহয় খুশি হয়েছে৷
রাতে মেসের খাবার পর্ব মিটে গেলে যে যার ঘরে চলে যায়৷ কেউ মোবাইলে কথা বলে, কেউ বা নেট দুনিয়ায় চোখ রাখে৷ কেউ কেউ আবার হোয়াটসআপ-ফেসবুক৷ ছাত্রদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক পড়ায় মন দেয়৷ বিমল ডাইনিং থেকে সোজা অঙ্কিতের রুমে, ভিতরে ঢুকেই দরজা আটকায়৷ বিছানায় আধশোয়া অঙ্কিত তখন মোবাইলে ব্যস্ত৷ এসময়ে বিমলকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত৷ সচরাচর ও তো আসে না, তবে আজ কী উদ্দেশ্যে? ‘কীরে হঠাৎ?’ অঙ্কিতের প্রশ্নে বিমল উত্তরদেয়- ‘কেন ? তোর রুমে আসা যাবে না ?’
--- আরে না না, তা নয়৷ তুই তো খুব একটা আসিস না৷ আচ্ছা ছাড় ওসব, বোস৷
অঙ্কিতের গায়ে হাত রেখে বসে বিমল৷ একথা সে কথার পর আসল কথায় আসে৷ ‘বলতো বন্ধু কী ব্যাপার তোর’?
--- কী ব্যাপার মানে ?
--- সব কিছু কি গোপন রাখা যায় রে ? বল না বল৷ অঙ্কিত এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে৷ ওদিকে বিমল যেন দূঢ় প্রতিজ্ঞ ওর মুখে শুনবেই আসল রহস্যটা৷ বিশাল আর তুই এত অন্তরঙ্গ, কী এমন হল যে---’
--- কেন ও কি তোকে কিছু বলেছে ?
--- না রে ৷ তবে এটা তো সত্যি৷ বিশালের নাম শুনে অঙ্কিত যেন কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ল৷ পরস্পরের এতই গাঢ় সম্পর্ক হঠাৎ করে ভেঙ্গে গেল তার ধাক্কা সামাল দেওয়া দু’জনের কাছে বেশ শক্ত৷ অঙ্কিত কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল৷ বিমল ওর ফাঁকা জায়গাটা দখল নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল নানান ভাবে৷
অঙ্কিত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- ‘ওর বোন আমাকে লাইক করে’- এটাই আমার বড় অপরাধ’ ৷ বিমল একটা শক্ত সাপোর্ট দিল অঙ্কিতকে যাতে ওর মুখে ডিটেলসটা পাওয়া যায়৷
প্রতিদিন ওরা দুই বন্ধু একসাথে কলেজে যাওয়া আসা করে৷ মেসে আর বিশালের বাড়ী- এদুটোতে দু’জনের অবাধ বিচরণ৷ একসাথে খাওয়া-শোয়া- বেড়ানো সব কিছু৷ দুটি দেহে যেন এক মন-প্রাণ৷ মুহূর্তের মধ্যে পরমাণু হামলার আঘাতে ভেঙ্গে খান খান৷ প্রতিরোধের কোনো সুযোগ নেই৷ বুঝে উঠার আগেই সব শেষ৷ ‘তা হলে এই বন্ধুত্ব কী আসল ছিল না’- প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে অঙ্কিতের মনে৷ ওর ফোন নম্বর পর্যন্ত ব্লাকলিস্টেড করে দিয়েছে৷ ভাবা যায়! এতো ঘৃণা !
ধাক্কাটা অবশ্য সামলে নিল অঙ্কিত৷ কিন্তু মনে একটা দগদগে দাগ রইল৷ দিন গেল- মাস গড়াল দেখতে দেখতে বছরও৷ ক্রমশ বিষয়টি অতীত৷ পরীক্ষা শেষ হলে অঙ্কিত মেস ছেড়ে গ্রামের বাড়ী ফিরল৷ পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য এগিয়ে আসতে হল ওকে৷ ভাই-বোনের পড়াশুনা, মা’র চিকিৎসা ৷ বাবা একা একা সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে৷ প্রাইভেট টিউশনি পড়িয়ে, কম্পিউটারে প্রেসের কিছু কাজ সব মিলিয়ে মাসে হাজার পাঁচেক৷ এরই মধ্যে চাকরির পরীক্ষায় বসা এবং ওসবের পিপারেশন নেওয়া৷ অঙ্কিত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যেভাবেই হোক জীবনে স্ট্যান্ড করতেই হবে৷ এরই মধ্যে মা’র ক্যান্সার ধরা পড়ল৷ বাজ ভাঙ্গল পরিবারের মাথায়৷ চিকিৎসার অত খরচ কীভাবে হবে৷ আত্মীয় সজ্জনের কাছে হাত পেতে বিশেষ কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেল না৷ ওর বাবা বিষন্ন মনে মাথায় হাত রেখে ভাবতে বসল৷ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কে না ছাড়ে৷ প্রতিবেশী এক ধনী ব্যক্তি তার একমাত্র প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল অঙ্কিতের কাছে৷ মা’কে সুস্থ করতে নিঃশ্বর্তে রাজী অঙ্কিত৷ কিন্তু বাঁধ সাধল ওর অসুস্থ মা৷ ওর বাবা উপায়ান্তর না দেখে বাড়ী বিক্রির কথা যখন ভাবছে ঠিক তখনই পোস্টাল বিভাগে অঙ্কিত একটা চাকরীর অ্যাপোয়েমেন্ট পেল৷ চাকরীতে যোগ দিতেই ব্যাঙ্কঋণের তোড়জোড়৷ মা’র চিকিৎসা জোড় কদমে চলতে লাগল৷ যেভাবেই হোক মা’কে বাঁচাতেই হবে৷ চেষ্টার ত্রুটি যেন না হয়- সে ব্যাপারে সতর্ক অঙ্কিত৷
পোষ্টাফিসে কাজে ব্যস্ত অঙ্কিত৷ সামনের লাইনের মধ্য থেকে একটা মেয়ে ডাকল- ‘ভালো আছো ?’ চোখ তুলে চাইতেই অঙ্কিত ফিরে গেল পাঁচ বছর আগের জগতে৷ জানালার বাইরে কোকিল ডাকছে কুহু---কুহু---- কুহু-----৷ তবে কি বসন্ত এসেছে ?
---------------------------------------------------------------------
নাছির মামুদ
রাজীব কুমার দাস
দোল পূর্ণিমা৷ শ্রীচৈতন্য দেবের ৫৩৪ তম জন্মতিথি৷ এমন সাম্যবাদী যুগপুরুষ, যিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চিরতরে মিটিয়ে দিতে ছেয়েছিলেন৷ এজন্য সব কিছু ত্যাগ করতে পিছু পা হননি৷ তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন নিত্যানন্দ, অদৈত্য আচার্য, শ্রীবাস, গদাধর, হরিদাস, রূপ-সনাতন, শ্রীজীব, শিবানন্দ সেন বেঙ্কটভট্ট, গোপাল ভট্ট, পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্র, পণ্ডিত সারভৌম ও প্রবোধানন্দ সরস্বতীর ন্যায় অগণিত বরেণ্য গুনীজন৷ বাংলা থেকে উরিষ্যা, দক্ষিণ ভারত, বিহার, অসম তথা উত্তর ভারতে এই সাম্যবাদী অহিংস আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল৷ খুব অল্প দিনের মধ্যেই আপামর জন মানসে একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি৷ অস্পৃশ্যতার মত খুবই নোংরা সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ের সব চেয়ে ফলপ্রসু অষুধ সম্মিলিত সংকীর্তন৷ ধর্মের কাঁটা ধর্মীয় পদ্ধতিতে উফড়ে ফেলার প্রয়াস৷ ধর্মীয় শোষণ আর নিপিড়ণের জোরদার প্রতিরোধ৷ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যাদের জন্য তারাই যদি পিছুপা হয়, তবে তো মুশকিল৷ শ্রীচৈতন্য চলেছেন গৌড়ের দিকে, সঙ্গে নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীঅদ্বৈত, গদাধর, শ্রীবাস পণ্ডিত আরও কয়েকজন৷ কখনো নৌকা তো কখনো আবার পায়ে হেঁটে, নীলাচল থেকে নবদ্বীপ হয়ে গৌড়৷ বাংলা-বিহারের রাজধানী গৌড়৷ চারিদিকে প্রশস্ত পরিখা৷ ভেতরের দিকে সুউচ্চ প্রাচীর৷ স্থলপথে প্রবেশ পথ দুটি- পূর্বে ও দক্ষিণে৷ অন্যদিকে জল পথেও দুটি প্রবেশ পথ হল উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম৷ নগরের মাঝখানে উচ্চ মিনার, যার ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে একেবারে উপরে উঠে দেখে নেওয়া যায় গঙ্গা নদী পথে নৌবহর এবং রাজধানীর চারদিক৷ দিন-রাত্রি অতন্দ্র প্রহরী নিয়োজিত রয়েছে দুই ভাবে, এক পদাতিক এবং দুই অশ্বারোহী৷ বাদশাহ হুসেন শাহের দরবারে প্রধানমন্ত্রী ও কোষাধক্ষ্য পদে আসীন দুই সুতীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দবির খাস ও সাঁকর মল্লিক৷ এরা উচ্চবর্ণের হিন্দু ধর্মালম্বী হলেও বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতার জন্য উচ্চ পদে বহাল৷ বাদশাহ’র দেওয়া পদবীতে ঢাকা পড়েছিল আসল পরিচয়৷ ফলে মুসলিম সমাজেও আদরনীয় ছিলেন৷
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিনটিতে শ্রীচৈতন্য সপারিষদ গৌড়ের উচ্চকন্ঠে রামকেলী গ্রামে এলেন৷ মুখে মুখে খবর পৌঁছাল মালদহ, রাজশাহী ও দিনাজপুরে৷ দলে দলে মানুষ জন এসে ভীড় করতে লাগল৷ বাদশাহ ভয় পেল, বিদ্রোহ নয় তো ? সজাগ নজর রাখা হল৷ রামকেলীর কোনো এক সহৃদয় সজ্জন ব্যাক্তির গৃহে আথিত্য গ্রহণ করেন মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ৷ দলে দলে লোকজন আসে আর যায়৷ শুধু একবার চোখের দেখা৷ আহাঃ কত সৌম্য শান্ত সুন্দর দর্শনধারী যেন চোখ জুড়ে যায়৷ কেউ কেউ সংকীর্তনে অংশও নিল৷ আবেগে ভাসল আগত জনতা৷
দিনে যাবার সাহস পেল না দরির ও সাঁকর৷ গভীর রাতের অন্ধকারে গেল দুই ভাই৷ সঙ্গে নিল ছোট ভাই অনুপমকেও৷ ঘরের ভিতরে দরজা বন্ধ করে সপরিষদ চৈতন্যকে কাছে পেল ওরা৷ অনেক আলোচনা চলল রাতভর৷ সমাজ, ধর্ম, মানুষের দুর্দশা আরো কত কী৷ বাদশাহ’র গোয়েন্দা চর নাছির মামুদ ঐ ঘরের বন্ধ জানালার ফাঁকে চোখ রাখল৷ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা ভরে গেল নাছিরের৷ দেখে শুনে যেন আশা মেটে না৷ এত লাবণ্য ! এত রূপ সে আগে কখনো দেখেনি৷ এত মধুর মিষ্টি কথাও সে শুনেননি আগে৷ আরো ভালো করে দেখার লোভে জানালায় আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকল৷ কিন্তু ঐ চাপে জানালার একটা পাল্লা আস্ত খুলে যেতেই ভয় পেল নাছির৷ এবার তবে পালাতে হবে৷ এমন সময় ভেতর থেকে ডাক এলো –কে? ওকি পালাচ্ছো কেন ? যেওনা ভাই ভেতরে এসো!
নাছির ঐ চিত্তাকর্ষক আহ্বান উপেক্ষা করে পালাতে পারল না, পিছু ফিরে এলো জানালার কাছে আগের মত৷
--- বাইরে কেনো? ভেতরে এসো ভাই!
--- না না, ভেতরে নয়৷ সাজিয়ে বলার মত অবস্থা ওর নেই৷ যেনো ওকে মন্ত্রমুগ্ধের মত বশ করে নিয়েছে৷
--- তুমি কে ?
--- আমি নাছির মামুদ৷ মুসলমান৷
--- তা হোক তুমিও আমার মত মানুষ৷ এসো, এসো ভেতরে এসো৷
দরজা খুলে ভেওয়া হল৷ এক পা দু’পা করে ধীরে ধীরে নাছির ভেতরে ঢুকল৷ শ্রীচৈতন্য দু’হাতে জড়িয়ে ধরল নাছিরকে তাঁর প্রশস্ত বুকে৷ নাছিরের ইতঃস্তত ভাব কেটে গেল৷ ওকে কাছে বসিয়ে অনেক আলোচনা-গল্প চলল বহুক্ষণ৷ নাছির আগে শুনেছিল উনি নাকি হিন্দুদের ভগবান৷ কেউ কেউ তাকে নীলাচলের সচল জগন্নাথও বলে থাকে৷ মানব প্রেম আর ঈশ্বর প্রেম যে আলাদা আলাদা নয় তা মর্মে মর্মে অনুভব করল নাছির মামুদ৷ বিভেদ থেকে জন্ম নেয় ঘৃণা আর বিদ্বেষ কিন্তু মানুষে মানুষে মেলবন্ধন হলে গড়ে ওঠে সম্প্রীতি- সৌহার্দ্য৷ শ্রীচৈতন্যের অগণিত গুণমুগ্ধ ভক্তের মধ্যে নাছিরও একজন অন্যতম৷ তা বলে ওকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হয়নি, বরং উভয় ধর্মের মূল বিষয় যে এক এবং অভিন্ন তা মরমে অনুভব করেছেন নাছির মামুদ৷
বৈষ্ণব পদাবলীর পদকল্পতরু নামে প্রাচীন গ্রন্থে নাছির মামুদের নামে পদ রয়েছে৷ এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে শ্রীচৈতন্যের সংস্পর্শে এসে নাছির ধর্মীয় উদারতা ও সম্প্রীতির আদর্শে অণুপ্রাণীত হয়েছিলেন৷
নাছিরকে সমাজ-সময়-ইতিহাস ভুলে গেলেও বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য ভুলে যায়নি৷ আজও বিভিন্ন পালাকীর্তনে ঐসব পদ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গাওয়া হয়৷ শ্রোতা-ভক্তেরাও শ্রদ্ধাবনতশীরে বৈষ্ণব পদকর্তার আসনে আসীন রেখেছেন নাছির মামুদকে৷
------------------------------------------------------------------
ভাবুক মন
বিকাশের মন উথালপাতাল, সকাল থেকে বিকেল, কিছুতে মন নেই৷ মা বলছে- ‘কীরে বাবু ! শরীর খারাপ লাগছে?’
--- কেন বলো তো ?
---- কেমন যেন মনে হচ্ছে৷
--- না না কিছু হয়নি৷
--- দুপুরে খেতে বসে খেলি না তো তেমন, তাই মায়ের মন ঠিক ধরেছে, ফাঁকি দেওয়া কি অতই সোজা৷ বিকাশ এবার বের হল বাড়ি থেকে৷ বাইরে ঘুরলে ফিরলে যদি মনটা চাঙ্গা মানে ফ্রেস হয়৷ বাউল বাজারে গেল প্রথমে, বন্ধুর দোকানে কিছুক্ষণ বসা৷ পরিচিতিদের সঙ্গে কথাবার্তা ৷ বন্ধু জিজ্ঞেস করল- ‘কীরে কিছু হয়েছে নাকি তোর ?’
--- না তো ৷ কেন, কী মনে হচ্ছে তোর ?
বন্ধু বলল- ‘তোকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাছে’ ৷
বিকাশ কৃত্রিম হেসে এড়িয়ে গেলে কি হবে, বন্ধুটি ঠিক ধরেছে৷ নাঃ এখানেও বেশীক্ষণ থাকা যাবে না৷ রওনা হলো বিকাশ, এবার মাঠের ধারে, খাড়ির পাড়ে৷ আজ একা একাই ভালো লাগছে৷ এলোমেলো ভাবনাগুলোকে সাজানো যাবে৷ ডুবন্ত সূর্যের লাল আলো মাঠের প্রান্তকে রাঙ্গিয়েছে বেশ৷ ভাবনার সাগরে ডুবেছে বিকাশের মন৷ ওদিকে সূর্য ডুবল পৃথিবীর সীমানায়৷ নাঃ আর নয়, এবার উঠতে হয়৷ রওনা হল বাড়ীর দিকে৷ বাতাসের বেগ হঠাৎ বাড়ল৷ মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে৷ যেমন করে ঝড় উঠেছে ওর মনে৷
বাড়ীতে ঢুকতেই বাবার প্রশ্ন-‘ ফোন রেখে গেছিস৷ বার বার ফোন বাজছিল৷ না ধরে পারলাম না৷’
--- যাবার সময় মনে ছিল না ফোন নিতে৷ কে করেছিল ?
--- তোর ক্লাসমেট, মিতা৷
--- মিতা ফোন করেছিল ?
--- হ্যাঁ, ওর নাকি আজ বিয়ে ?
---- ও হ্যাঁ হ্যাঁ ৷
--- জিজ্ঞেস করল তুই রওনা হয়েছিস কিনা,
--- না বলতেই একটু অবাক হল বোধহয়৷ তুই যাবি বলেছিলি ?
--- না তো৷ সেরকম কিছু বলিনি৷ নিজের ঘরে ঢুকল বিকাশ৷ বিছানায় বসে পড়ল হতাশ ভাবে৷ আজকের দিনেও মিতার মনে আছে আমার কথা৷ অনেক বন্ধু-আত্মীয় সজ্জন সবাই তো আছে৷ প্রতিদিন কলেজ থেকে একসাথে ফেরার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল মানস চোখে৷ প্রাইভেট টিউশন থেকে ফিরতে রাত হলে বাড়ীতে পৌঁছে দিত৷ ভালোকিছু রান্না হলেই মিতা বন্ধুকে বলত- ‘মা তোকে যেতে বলেছে৷’
--- কাকিমা যখন বলেছেন, তবে তো যেতেই হবে৷
তিন তিনটা বছর একসাথে ক্লাস, পড়া, আলোচনা, গল্প, আড্ডা৷ অবশ্য তাতে ওরা দু’জন ছাড়াও আরো পাঁচ-ছয়জন বন্ধু৷ একটা গ্রুপ৷ ঘুরতে হোক বা সিনেমা৷ প্রত্যেকের জন্মদিনে শুভেছা বিনিময়ে পাশাপাশি খাওয়া দাওয়াও হত পালা করে৷ একের বিপদে সবাই পাশে থাকত অত্যন্ত স্বত্বঃস্ফুর্ততার সাথে৷ সে সব স্মৃতি কি আজকের দিনেই মনে পড়তে হবে৷ বিকাশ অবাক হয়ে নিজেই প্রশ্ন করে বার বার৷ বিয়ে হয়ে গেলে প্রিয় বন্ধু কী দূরে চলে যায় না কি অন্যের হয়ে যায় ? বন্ধুর জন্য তখন কি মনে কোনোই জায়গা থাকে না? কি জানি ! কতকত উদ্ভট্ট প্রশ্ন জাল ঘিরে ধরে ওকে৷ কোনো দিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে ওরা পরস্পরকে নোট আদান প্রদান করেছে কতবার তাঁর হিসেব নেই৷ ছুটিতে বিকাশ বর্ধমান থেকে বাড়ী এলেও ফোনে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত৷
আজকে মিতার বিয়েতে ওর না থাকাটা অন্য বন্ধুরা কীভাবে নেবে বিকাশ সেটাও ভাবছে৷ কাকু কাকিমা ? যারা ভরসা করেছে এত দিন৷ একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে তা সত্যি বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে অভাবনীয়৷ অথচ আজ কেন বিকাশের মন উদাস হলো! তবে কী ও নিজের মনটাকেই বুঝে উঠতে পারেনি এতদিন ? এও কী সম্ভব! না না তা কেন! তবে যে দিন স্মপা বৌদি বিকাশকে ডেকে একান্তে বলল-‘তোদের দু’জনকে না বেশ মানিয়েছে!’ বিকাশ তৎক্ষণাত বৌদিকে স্মরণ করলো –‘ বৌদি আমরা শুধুই বন্ধু, অন্য কোনো বিশেষ সম্পর্ক নয়৷’ তারপর সম্পাবৌদি আর কোনোদিন ঘাটায় নি৷ তবে আজ এ কী সব ভাবছে বিকাশ৷ মানুষের মন, কখন যে কি ভাবান্তর হয়৷
বিকাশ কাগজ কলম নিয়ে বসল কবিতা লিখতে৷ কবিতায় ধরে রাখবে আজকের ওর মনের অবসস্থাটা আকাশে মেঘ জমেছে, গুরুগুরু গম্ভীর গর্জনও মাঝে মধ্যে৷ মনে হয় বৃষ্টি নামবে৷ নামুক, বেশ হবে৷ ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে কেমন হয়? বোধহয় মন্দ হবে না৷।
-------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment