প্রভাতদার সঙ্গে সুদিনের আলাপ, লণ্ডনের ভারতীয় ছাত্রাবাসে। সুদিন ইম্পিরিয়াল কলেজ অফ সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনলজিতে এম ফিল করছে। তখনকার দিনে গুগলস ছিল না, কিন্তু সবজান্তা প্রভাতদা ছিলেন। রোববারের প্রাতঃরাশের টেবিলে সুদিন হয়তো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, আচ্ছা প্রভাতদা, গামছা ভাল? না তোয়ালে ভালো? প্রভাতদা বেশ একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে, আলোচনা শুরু করলেন। সকলে তখন সেই আলোচনায় যোগ দিলেন। জায়গা বিশেষে অনেকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলে আসর আরও বেশ জমে উঠত।
প্রভাতদাকে শুধু উস্কে দেওয়ার অপেক্ষা। এবিষয়ে লোকের অভাব হত না। অনেকদিন এমনও হয়েছে যে, আলোচনাটির অবতারণা যিনি করেছিলেন, তিনি আগেই আসর ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আলোচনা চলতেই থাকত।
-আচ্ছা, প্রভাতদা, আপনি কি বিশ্বাস করেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এখনও জীবিত আছেন?
-দেখুন, ওনার জন্ম তারিখ অনুযায়ী, ওনার বয়স আজ প্রায় ৭২, তাহলে ধরে নেওয়াই যায়, উনি বেঁচে আছেন। তবে এখন ঠিক কোথায় আছেন বা থাকতে পারেন তা কিন্তু জানি না।
আর একদিন একজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা প্রভাতদা, দেশপ্রেম কী?
-এতো সকলেই জানে, মাতৃভূমির প্রতি এক ধরনের আবেগপূর্ণ অনুরাগ বা ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। সেটা দেশের প্রতি একজন ব্যক্তির বা কোনো এক জনগোষ্ঠীরও অনুভূতি হতে পারে। আবার এভাবেও বলা যেতে পারে দেশপ্রেম হচ্ছে একজনের দৃঢ় প্রত্যয় যে আমার দেশটা অন্যান্য দেশের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। এবং আমি এখানেই জন্মগ্রহণ করেছি।
ফোঁড়ন কাটার লোকের অভাব হয় না, একজন প্রশ্ন রাখলেন, আচ্ছা, প্রভাতদা, আপনার কি দেশপ্রেম আছে?
-কেন থাকবে না? আপনাদের কি সন্দেহ আছে?
-না, মানে, এতদিন আপনি দেশ ছেড়ে, বৌদিকে ছেড়ে লণ্ডনে রয়ে গেছেন, লোকের মনে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে।
এই প্রথম প্রভাতদা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে দেখে সুদিন বলল, না, না, ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন এখানে চলবে না।
উপরোক্ত বক্তব্যটি সভার মাঝে রাখলেও সুদিনের নিজের মনেও কিন্তু অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হতে শুরু করে।সুদিন নিজেই চিন্তামগ্ন হয়ে পড়াতে, প্রভাতদার কোনো কথা ওর কানে যেন আর পৌঁছয় না। সেই নিষ্পাপ বালিকাটির মুখটা ভেসে ওঠে মনে, ওর না বলা প্রশ্নগুলোও যেন সুদিনের কানে সশব্দে উচ্চারিত হতে থাকে, সুদিনদা, তোমার স্কলারশিপ কবে শেষ হবে? দু বছর তো অনেকদিন শেষ হয়ে গেছে! তোমার তাহলে চলছে কীভাবে? সুদিনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে আজ শত শত লোক যেন প্রশ্ন করছে, এক বছরের স্কলারশিপের নাম করে, তুমি কেন লণ্ডনে গিয়ে বসে আছ? এই কি তোমার দেশপ্রেমের নমুনা?
সুদিনের কিছু আর তখন ভাল লাগে না। চেয়ার ছেড়ে সুদিনকে উঠতে দেখে, অনেকেই প্রশ্ন করল, উঠছেন?
-যাই, কাজ আছে।
ঘরে এসে, শুয়ে পড়ল সুদিন। নানা চিন্তা ওর মাথায়। অনেকেই ওকে বুঝিয়েছে, আরে ভুলে যান দেশপ্রেম, বিদেশে আসার সুযোগ যখন পেয়েছেন, সুযোগের সৎ ব্যবহার করুন। দেশে না ফিরে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় চলে যান, ওখানে অনেক টাকা। কী আছে, স্কলারশিপের টাকা প্রয়োজন হলে সরকারকে ফিরিয়ে দেবেন।
কথাগুলোর মধ্যে যুক্তি আছে, কিন্তু মা-বাবার মুখ দু'টো যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঐ নিষ্পাপ চোখ দুটোর ভাষা যখন শব্দায়িত হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, তখন সুদিনের সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে যায়।
না, টাকাটা সব কিছুর মাপ কাঠি হতে পারে না। দেশ ওকে চাইছে। দেশের সেবা, মা-বাবার সেবা তো করতেই হবে। এটা কর্তব্য। সুদিন দেশে ফিরবেই।
সুদিন চিঠি লিখতে বসে গেল।
-o-