ঘৃতকুমারী -- জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও মানবজাতিই বোধহয় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। পরিবেশের উন্নতি সাধন কল্পে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়।
স্ত্রীবিয়োগের পর সুদিনের একাকিত্বের জীবন শুরু হয়েছিল সহধর্মিনীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন থেকেই। কিছু বলার নেই, সকলেরই বিভিন্ন কারণ ও ব্যস্ততা তো থাকতেই পারে। বহু বছর পর আত্মীয় বা বন্ধুদের কারও সঙ্গে দেখা হলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা হয়তো প্রশ্ন করে বসেন, আপনি একা থাকেন কী করে? আপনার ভয় করে না? সুদিনের নির্লিপ্ত উত্তর, আমি তো একা থাকি না, আমার সঙ্গে তো ঠাকুর থাকেন! তিনি হচ্ছেন প্রজ্ঞানপুরুষ শ্রীশ্রীবাবাঠাকুর। আর ভয়ের কথা বলছেন? কীসের? যার জন্য অপেক্ষা তাকে ভয় করব কেন? সুদিন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে বেঁচে থাকার আর এক নাম মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। মৃত্যুর বিষয়ে শিখারও কোনো উদ্বেগ ছিল না, এই প্রসঙ্গ উঠলেই বলত, দেখো সময় হলে ঠাকুর আমাদের না ভুগিয়েই নিয়ে চলে যাবেন। প্রকৃতি তার নিজস্ব্ খেয়ালে চলে, তাই প্রকৃতিকে তার মত চলতে দেওয়াই ভাল।
***
মার্চ্ ২০২০, চারদিকে কোভিড-১৯এর ভ্রুকুটি। শিখার মত সুদিনেরও মৃত্যুভয় নেই। কিন্তু, ওর এক বোনের মনে হল, দাদার বোধহয়, এভাবে একা থাকাটা ঠিক হবে না! ইতিমধ্যে, সুদিনের একাকিত্বের জীবনে স্থান পেয়েছে আরও কয়েকটি প্রাণী যাদের জন্য সুদিনকে রোজই একটু ব্যস্ত থাকতে হয়। ওদের কথা ভেবে সুদিন সাধারণতঃ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইত না। তাই, এখন সমস্যা দেখা দিল তাদেরকে নিয়ে। বোনের ওখানে চলে গেলে, এদের তখন দেখবে কে? তবে, অনেকের মতে, সামান্য তো ক'টা গাছ, এদের জন্য আবার এত মায়া! বোনের যুক্তি, ঠিক আছে, তেমন হলে মাঝে দু'একদিন এসে জল টল দিয়ে এবং একটু দেখাশুনো করে গেলেই না হয় হবে।
***
তারপর তো পরপর বহু ঘটনা ঘটল! বাস বন্ধ, মেট্রো বন্ধ। মাঝে অবশ্য প্রতিবেশীরা খবর দিয়েছেন, সুদিনের ব্যালকনির পুঁই ডগাগুলো বেশ লকলকে হয়েছে। নয়নতারা ফুলও ফুটছে। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি তো হচ্ছেই, ব্যালকনির কিনারায় রাখা গাছগুলো বৃষ্টির জল পাওয়ার ফলে টিকে আছে।
***
তারপর সুদিন নিজেই কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হল। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও কয়েক মাস। দেখতে দেখতে নূতন বছরও এসে গেল।
জানুয়ারি, ২০২১। সুদিনের মনে হল, অনেকদিন হল বাড়ির বাইরে। গাছগুলো তো নিশ্চয়ই শুকিয়ে মরে গেছে। আবার নূতন করে সব শুরু করতে হবে। বোন বলল, অনেক দিনের ব্যবধানে বাড়ি ফেরা তো, আমিও না হয় যাব, ঘর দোর সব পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে আসবো।
জানুয়ারির মাঝামাঝি এক রোববারে দাদাকে নিয়ে বোন এল উত্তর কোলকাতার সেই ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই শিখার চোখে চোখ পড়ে গেল সুদিনের। আগের মত শিখা যেন বলে উঠল, ভালো আছ তো! তারপর সুদিন ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এখন একটা গাছও আর বেঁচে নেই! তারপর ভিতরে এসে ওর শোবার ঘরে প্রবেশ করল। জানলার পাল্লা খুলতে গিয়ে চোখ পড়ল জানলায় রাখা একটা টবের উপর। প্রায় দশ মাস ওতে কোনো জল দেওয়া হয়নি। অবাক বিস্ময়ে সুদিন দেখলো ওতে রাখা গাছটা তখনও বেশ সতেজ আছে। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল! টবের গাছটার নাম, ঘৃতকুমারী! গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুদিনের যেন মনে হল, গাছটা এই দশটা মাস ওর জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে, যেন বলছে, আর পারছি না, এবার একটু জল দাও।
-o-
Khub bhalo laglo. Money hocchilo ami tomakey ar Jethima ke dekhchi.
ReplyDelete