Sunday, 5 December 2021

জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় - প্রতিবন্ধী


 

আমাদের এক প্রতিবেশী হচ্ছেন শ্রীঅপরাজিত সরকার। ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে এক প্রকার প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করছেন। উনি নিজে রান্না তো দূরের কথা এক কাপ চা-ও তৈরি করতে পারেন না। হ্যাঁ, তাই বলে কি আর চা তেষ্টা পায় না? নিশ্চয়ই পায়, কয়েক বছর আগে আমরা ওনাকে একটা ইলেকট্রিক কেটলি কিনে দিয়েছি, তাতে জল গরম করে টি-ব্যাগ ডুবিয়ে চা বানিয়ে নিতে পারেন। এইটুকু করতে পেরেই উনি যথেষ্ঠ খুশি।
কোভিড-১৯এর প্রাদুর্ভাবের পর, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ওনার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পেল। পায়ের ব্যথার কারণে, উনি বাজারেও খুব একটা যেতেন না। এখন করোনার ভয়ে সেটাও বন্ধ করে দিলেন। আমরা পাড়ার সকলে মিলে ওনার বাজার করে দিচ্ছিলাম। খাওয়া দাওয়ার জন্য উনি হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। একই ধরনের রান্না খেতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে উনি পালাক্রমে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে খাবার নিতেন। প্রাতঃরাশ নিতেন বিশেষ কোনো এক পরিবার থেকে আর বিকেলের জলখাবার আসত পাড়ার এক দোকান থেকে।
এত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও উনি কিন্তু প্রতিবন্ধী নন, কারণ সরকারের চোখে উনি প্রতিবন্ধী হিসাবে স্বীকৃত নন।
যাইহোক, একাকিত্বের ও করোনার কারণে ওনার এই প্রতিবন্ধী জীবনযাপন আমাদের ভাল লাগত না, তবু সকলে নিশ্চিত ছিলাম যে ওনার হয়তো কিছু হবে না।

***

এত সব সাবধানতা সত্ত্বেও কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। করোনার কোনো উপসর্গ যেমন জ্বর, শুকনো কাশি, গলাব্যথা, শরীরে ব্যথা এসব কিছুই ছিল না। থাকার মধ্যে আমাশয়ের মত পায়খানা ও পেটে ব্যথা। ওনার হাউস ফিজিসিয়ান সব শুনে পিয়ারলেস হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। ওনারা ভর্তিও করে নিলেন।
ভর্তি হওয়ার পরের দিনই করোনা পজিটিভ ধরা পড়ল। হাসপাতালে থাকাকালীন, ওনার বিশেষ কয়েকটি উপলব্ধি হয়েছিল। উনি এমনিতে প্রজ্ঞানপুরুষ শ্রীশ্রীবাবাঠাকুরের আশ্রিত। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে উনি সবসময় শ্রীশ্রীবাবাঠাকুরকে স্মরণ করতেন আর বলতেন, হে ঠাকুর, আমি সব কিছু তোমার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছি। আমি বন্ধনমুক্ত, আমার কোনো পিছটান নেই। তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই। আর যদি মনে কর পৃথিবীতে আমার কাজ আছে, তাহলে আমায় বলে দাও কী করবো আর আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল। এই প্রতিবন্ধী জীবন আর আমার ভাল লাগছে না।
সপ্তাহ দুয়েক বাদে কোভিড-১৯ এর নিগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেল। হাসপাতাল থেকে যিনি ফিরলেন তিনি কিন্তু সম্পূর্ণ এক নূতন ব্যক্তি। ওনার স্মৃতিশক্তি অনেক হ্রাস পেয়েছে। মোবাইল কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। ভারসাম্য রক্ষা করতে অপারগ হওয়ার কারণে হাঁটতে ওনার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু, ঈশ্বরের উপর ওনার বিশ্বাস এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে উনি নিশ্চিত যে এইসব দুর্বলতা খুবই সাময়িক এবং ক্রমশঃ সব দূর হয়ে যাবে। 
এই চিন্তাধারার কারণে, ওনার মধ্যে সব সময় শান্ত সমাহিত এক ভাব বিরাজ করতো। উল্লেখ করেছিলাম, উনি মোবাইল কী করে ব্যবহার করতে হয় তা প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, উনি নিশ্চিত ছিলেন যে ক্রমশঃ সব কিছু একদিন আবার ফিরে আসবেই। মাঝে মাঝেই উনি বলতেন, আজ সকালে মোবাইল চালু করতেই ঐ জিনিসটা মনে পড়ে গেল। জয় শ্রীশ্রীবাবাঠাকুর। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর কথা বলতে গেলেই ওনার কাশি হত। সেটাও ক্রমশঃ হ্রাস পেল |

No comments:

Post a Comment