মঞ্চে মেয়ের বক্তৃতা শুনে কমলেন্দু বাবুর চোখে জল চলে এলো। ছোট থেকেই মেয়েটা বড় লিখতে ভালোবাসত। একদম ওর মায়ের মতো লেখার প্রতি ভালোবাসা ছিল মেয়েটার।
কমলেন্দু বাবুর স্ত্রী অনিতা দেবীও লেখালেখি, সাহিত্য-চর্চা করতে খুব ভালোবাসতেন। যে'দিন অনিতা দেবীর এই সখের কথা কমলেন্দু বাবুর মা আর দুই দিদির কানে যায়, কি অশান্তিটাই না তারা করেছিলেন! অনিতা দেবীর লেখার সাধের লাল ডায়রিটা তারা আগুনেই পুড়িয়ে দিলেন। মেয়েমানুষের আবার পড়াশোনা, লেখালেখি কীসের?! যতসব আদিখ্যেতা, সংসারের কাজ না করে পটের বিবি সেজে বসে থাকার ফন্দি। সংসারের যাবতীয় কাজ চাপিয়ে দিতে লাগলেন অনিতা দেবীর ওপর, যাতে দিনের শেষে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে তার সাহিত্য-চর্চার ভুত ঘাড় থেকে নেমে যায় তবু অনিতা দেবী দিনান্তে গোপনে তার প্রাণের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। এ'জন্য স্বামীর কাছেও কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় নি তাকে! সে'দিন মাতৃভক্ত কমলেন্দু বাবুও বৌকে অপমান করতে ছাড়েন নি। বড় ভুল হয়ে গেছিল তার!
অন্নপ্রাশনে মেয়ে যখন সব কিছু ছেড়ে বই আর পেন তুলে নিল, অনিতা দেবীর বোধহয় বুক কেঁপে উঠেছিল, তার মতোই মেয়েরও পরিণতি হবে না তো?! এরপর সব চোখরাঙানি অগ্ৰাহ্য করে মেয়ের লেখালেখি আপন ছন্দে এগিয়ে গেছে। অনিতা দেবী নিজের অপূর্ণ সাধ পূর্ণ করতেন মেয়ের হাত ধরে। লুকিয়ে মেয়েকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিতেন। প্রাণাধিক প্রিয় মেয়েকে কোনো কিছুতে বাধা দেন নি কমলেন্দু বাবু। নিজের স্ত্রীকেও যদি এই স্বাধীনতা দিতে পারতেন, হয়তো আরেকটি কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটতে পারত। অনুতপ্ত কমলেন্দু বাবুর আফসোসে মনটা ভরে উঠলো। আজ অনিতা দেবী বেঁচে থাকলে মেয়ের সাফল্যে খুব খুশি হতেন, তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ হতো।
মঞ্চে তখন 'রবীন্দ্র পুরস্কার' প্রাপ্ত স্বর্ণালী দেবী ডেকে নিয়েছেন তার বাবাকে, "যে মানুষটা না থাকলে লেখার অনুপ্রেরণা পেতাম না, তিনি আমার বাবা, তাকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি।" ঝাপসা চোখে মঞ্চে উঠে এলেন কমলেন্দু বাবু। স্বর্ণালী দেবী বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, "ভাগ্যিস্, মায়ের মতো বিদুষী নারীর চলার পথে তোমরা এত বাধা দিয়েছিলে, তাই তো আমার জেদটা দ্বিগুণ বেড়ে গেছিল। মা কিন্তু বীরাঙ্গনার মতো আমাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিল, কখনো আমাকে হেরে যেতে দেয় নি।" অনুকম্পিত, লজ্জিত কমলেন্দু বাবু মোখ নীচু করে নিলেন, ঠিকই তো, সত্যিকারের পুরুষ মানুষ কখনো নারীর অধিকারের পথে, অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, বরং নারীর হাত ধরে একই সঙ্গে পথ পাড়ি দেয়। সেই রকম পুরুষ, সেই রকম স্বামী আর হতে পারল কোথায় সে?! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে নিজের ভুল সংশোধন করলেন তিনি।
No comments:
Post a Comment